প্রতিহিংসার রাজনীতি নাকি সাম্প্রদায়িকতা?
সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের কারণ এখন সবার কাছেই স্পষ্ট:
১.ভূমিদস্যুতা: অন্যদের চেয়ে সংখ্যালঘুদের জমি দখল করাটা সহজ—তাদের ওপর আক্রমণটা তীব্র করলে তারা ভিটেমাটি ফেলে জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পার হয়ে চলে যাবে, এ রকম প্রত্যয় থেকে হামলা হয়। এই হামলায় থাকে সব দলের ভূমিদখলদার।
বিভিন্ন রিপোর্ট এবং গবেষণায় উঠে এসেছে সনাতন ধর্মালম্বীদের জমি বা সম্পত্তি দখলের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা জামায়াত কেউই পিছিয়ে নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বললেও মাঠ পর্যায়ের আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মীই সুযোগ পেলে হিন্দুদের জমি- সম্পত্তি দখলে পিছপা হন নাই। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো এ দলটির নেতাকর্মীরা রাজনীতিতে যারা ধর্মের মিশ্রণ ঘটাতে চান অর্থাৎ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা জামায়াতের চেয়ে বেশি সম্পত্তি দখল করেছেন।
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বাম রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা, যারা নিজেদের প্রকৃত সেক্যুলার বলে দাবি করেন তারাও এ দখল প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছেন, যদিও আনুপাতিক হারে উপরে উল্লেখিত দলগুলোর চেয়ে অনেক কম। যেহেতু এ দলগুলোর সমাজ এবং রাষ্ট্রে তেমন প্রভাব নেই, তাই তাদের দখল করবার ক্ষমতাও তুলনামূলক ভাবে অনেক কম।
২.উগ্র হিন্দুত্ববাদ: যারা মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগের জায়গা ( কুরআন, রাসূল, কা’বা) নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ অনলাইন- অফলাইনে প্রচার করে।
তিনি (রানা দাশগুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক, হিন্দু-বৌদ্ধ- খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ) আবার ঝড় তুলেছেন। ফরিদপুরে এক হিন্দু ভদ্রলোকের বাড়িঘর বিক্রি নিয়ে যে বিতর্ক তাতে সরকারের প্রভাবশালী মানুষজন আছে জেনেও তিনি কেন এসব বলতে গেছেন কে জানে! যার বাড়ি সে বলছে, আমি বেচেছি। আর এরা বলছেন, কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যেও রাজনীতি আছে। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো মানুষ উদ্বাস্তু হয়। তারা কে কীভাবে কোন দেশে যায় আমরা জানিও না। তাহলে কেন এই ভদ্রলোক শিরোনাম হলেন?
এই যে কিছুদিন আগে প্রবীর শিকদার বিপদে পড়লেন, যারা তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তারা কি সবাই হিন্দু? যারা তাকে গলায় মালা দিয়ে বরণ করে এনেছিল, তারা কি সবাই সংখ্যালঘু? ফলে আজ আবার সংকীর্ণতা বা সংখ্যালঘু রাজনীতির নামে ঘটনা উস্কে দেওয়ার কাজটা ভালো ঠেকছে না।
অজয় দাশগুপ্ত-এর কলাম
(সংখ্যালঘু সমস্যার নামে নতুন বিভক্তি কেন?)
বিডিনিউজ (৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫)
৩. ভারতীয় উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতাদের উস্কানীমূলক বক্তব্য:
বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন রকমের রাজনৈতিক কারণে, নিজেদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে শক্তিশালী করবার তাগিদে, হিন্দু সম্প্রদায়ের যে অংশ ভারতবর্ষের চলে এসেছেন, তারা শাসকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা পাতিয়ে ভারতবর্ষের বুকে নিজেদের অবস্থানকে বৈধ করে নিয়ে, বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি, সেখানকার নাগরিকদের, সর্বিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে একটা ভয়াবহ অসত্য অপবাদ ছড়িয়ে ভারতবর্ষে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি আরএসএস ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে শক্তিশালী করেছে।
বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ বাংলাদেশের গোটা নাগরিক সমাজ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতবর্ষে ভয়ঙ্কর প্ররোচনামূলক গুজব ছড়িয়ে আরএসএস বিজেপিকে নানাভাবে সাহায্য করে চলেছে।
এই কাজটি কার্যত গত শতাব্দীর নয়ের দশকের প্রথম পর্ব থেকে শুরু করেছিলেন তসলিমা নাসরিন, সালাম আজাদের মত বেশ কিছু বাংলাদেশের নাগরিক। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি কর্তৃক ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের ঘটনাক্রমকে কেন্দ্র করে ‘লজ্জা’ নামক একটি ভয়ঙ্কর প্ররোচনামূলক, অসত্য কাহিনীনির্ভর উপন্যাস রচনা করেছিলেন তাসলিমা নাসরিন।
গৌতম রায়-এর কলাম (বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন: ফল পাবে বিজেপি?)
বিডিনিউজ (২৩ অক্টোবর ২০১৯)
৪. তাদের গায়ে আওয়ামী ভোটব্যাংকের সিল পড়ে যাওয়া।
৫. গুজবের কারণে অসহিষ্ণুতা, যা ভিন্ন ধর্মের মানুষ ও তাদের মন্দির-প্যাগোডা-গির্জার ওপর আক্রমণকে উস্কে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে সাম্প্রদায়িক বা যে কোনো ধরনের দাঙ্গার পিছনের মূল কারণ হলো রাজনৈতিক।
কেননা উগ্রবাদীরা যখন ভিন্ন ধর্মের মানুষকে নির্যাতন করে, তাদের উপাসনালয়ে আগুন দেয়, তার প্রতিবাদও জোরেশোরে হয় না। দলগুলো ব্যস্ত থাকে ভোটের এবং ক্ষমতার চিন্তায়, প্রশাসন ব্যস্ত থাকে সরকারের মতলব বুঝে কাজ করতে। কোনটা আন্তরিকতা, কোনটা ঠোঁটসেবা, তা তো প্রশাসনের মানুষ বোঝে। সে জন্য আইনের হাতটাও আর লম্বা হয় না। আইনের হাতটা দিন দিন ছোটই হচ্ছে, বরং বিশেষ করে প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষ এবং সংখ্যালঘুদের জন্য।
কিন্তু এই অবস্থা তো চলতে দেওয়া যায় না।
প্রথম আলো (১৫.১.২০১৪) (১১.১১.২০১৬)