সূরা ফাতেহা’র ধারাবাহিক দারস (১)
-মুফতি আবদুর রহমান গিলমান
“পরম করুণাময় আল্লাহর নামে (শুরু করছি)”
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পবিত্র কুরআনুল কারিমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি যেভাবে সূরা নামলের একটি আয়াত, তেমনি সূরায়ে তাওবাহ ব্যতিত সকল সূরার শুরুতে আসন গ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। মুফাসসিরানে কিরাম বলেন, পূর্ববর্তি সমস্ত আসমানী কিতাবের সারাংশ হলো কুরআনুল কারীম। কুরআনুল কারীমের সারাংশ সুরা ফতেহা। সূরায়ে ফাতেহার সারাংশ ‘বিসমিল্লাহি রাহমানির রাহিম’। তাই বুঝা গেল, পূর্ববতী সমস্ত আসমানী কিতাব ও কুরআনুল কারীম যেন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ নিজের মধ্যে ধারণ করে রেখেছে।
নাযিলের প্রেক্ষাপট
তাফসীরে ইবনে কাসীরে হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে ‘বিসামল্লাহ’ নাযিলের প্রেক্ষাপট জানাযায়। তিনি বলেন, যখন বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম অবতীর্ণ হয়, তখন মেঘমালা পূর্বদিকে সরে যায়, বাতাসের চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, সমুদ্র শান্ত হয়ে যায়, প্রণীকুল কান খাড়া করে রাখে, আসমান হতে শয়তানের উপর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিক্ষিপ্ত হয় এবং আল্লাহ তায়ালা নিজের ইজ্জতের কসম করে বলেন, যে কাজ আমার এই নাম ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ নেওয়া হবে, তাতে অবশ্যই বরকত হবে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১ম খন্ড, ২২ নং পৃষ্ঠা)
বিসমিল্লাহ সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ হাদিস
হুজুর সা. ইরশাদ করেন, প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ যা বিসমিল্লাহ দ্বারা শুরু করা হয়না, ঐ কাজটি অসম্পূর্ণ হয়। এই হাদিসটি বিভিন্ন সূত্রে শব্দের পরিবর্তনে একাধিকবার বর্ণিত হয়েছে। হাদিসের সারমর্ম হলো প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিসমিল্লাহ দ্বারা শুরু করা উচিৎ। তাহলে সেই কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন হবে এবং তাতে বরকত নিহীত থাকবে। এই হাদিসটির মাঝে দুটি বিষয়ের ওপর সামান্য আলোকপাত করা সমীচিন মনে হচ্ছে। প্রথমত: গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলতে কি বুঝায়? দ্বিতীয়ত: অসম্পূর্ণ হওয়া অর্থ কি? হাদিসে যে গুরুত্বপুর্ণ কাজের কথা বলা হয়েছে, তার জন্য সর্বপ্রথম শর্ত হলো, সে কাজটি ইসলাম অনুমোদিত হতে হবে। যদি কেউ অনৈসলামিক কাজে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করে, সে ক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ এর চরম অবমাননা হবে এবং আল্লাহ তায়ালার নাম ও কুরআনের আয়াতকে নিয়ে ঠাট্টা করার কারণে তার ঈমান চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যেমন, কেউ মদপান, যিনা, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, দূর্নীতি ইত্যাদি করার সময় বিসমিল্লাহ বললো, কোন সিনেমা বা এজাতীয় দোকান-পাট বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা, কোন অশ্লীল বা ইসরঅম বিরেধী বই-পুস্তক উপন্যাস বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা বা কুরআনের আয়াত সংযুক্ত করা ইত্যাদি সবই অন্যায়। অনুরূপভাবে কোন সংবিধান, গঠনতন্ত্র বা নীতিমালা যদি পরিপূর্ণ কুরআন সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক হয়, যার ভিত্তিই হয় ইসরামের সাথে সাংঘর্ষিক, সেই সংবিধানে ধর্মপ্রাণ তৌহিদী জনাতার সমর্থন আদায়ের জন্য হীন রাজনৈতিক ¯^ার্থে বিসমিল্লাহ এর ব্যবহারও চরম ধৃষ্ঠতার শামিল।
তবে হ্যাঁ যে সংবিধান কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী হবেনা, সে সংবিধান অবশ্যই হাদিসে বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ কাজের অন্তর্ভূক্ত হবে এবং তা বিসমিল্লাহ বলেই শুরু করবে। যেমন হোদাইবিয়ার সন্ধি, মদিনা সনদ আল্লাহর নাম দিয়েই শুরু হয়েছিল। সুতারাং ইসলাম অনুমোদিত ইসলাম বা জাগতিক সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিসমিল্লাহ দ্বারা শুরু করা উচিৎ। একজন মুসলমানের সকল ব্যক্তিগত কাজ, মুসলমানদের যে কোন সংগঠন, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ তার প্রধান ব্যক্তির উপস্থিতিতে শুরু করা হয়। এটাও সৌভাগ্যের বিষয় মনেকরা, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার নাম নিয়ে সে কাজ শুরু করা হলে তার গুরুত্ব ও সৌভাগ্যের পরিমাণ কতগুণ বেড়ে যাবে? হাদিসের দ্বিতীয় বিষয়: অসম্পূর্ণ হওয়ার অর্থ: বাহ্যিক ভাবে সব কাজই বিসমিল্লাহ না বললেও দেখা যায় তা সম্পন্ন হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে হাদীস অসম্পূর্ণ হওয়ার অর্থ হলো- বরকতশুণ্য হওয়া। অর্থাৎ: বিসমিল্লাহ না বললে ঐ কাজকে কোন বরকত হবেনা এবং পরকালে এর জন্য কোন সওয়াব পাবেনা।
বিভিন্ন কাজে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
রাসূল সা. যখন বিভিন্ন গভর্নরদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি দিয়েছেন, তখন বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লিখে চিঠি লিখেছেন। অনুরুপভাবে হযরত সুলাইমান আ. ও যখন রাণী বিলকীসের নিকট চিঠি লিখেছিলেন তখন বিসমিল্লাহ দিয়েই লিখেছেন। সে হিসেবে মুসলিম রাষ্ট্রের সকল রাষ্ট্রিয় চিঠিপত্র সাংগঠনিক চিঠিপ্রত্র ইত্যাদিতে বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করাই ইসলামের নিয়ম। কোন জালিমের সামনে পঞ্চাশবার বিসমিল্লাহ পড়লে, আল্লাহ তায়ালা জালিমকে পরাজিত করে তাকে বিজয় দান করবেণ। (সূত্র: বিস্ময়কর বিসমিল্লাহ)
হযরত আলী রা. বলেন, যে কোন কঠিন কাজ সহজে সম্পাদনের জন্য বিসমিল্লাহ বলে শুরু করবে। (সূত্র: ফাজায়েলে বিসমিল্লাহ)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত আছে যে, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এর মাঝে আরবী ১৯টি অক্ষর রয়েছে, আর জাহান্নামের ফেরেশতাও ১৯ জন। সুতারাং যে ব্যক্তি প্রত্যেক কাজে বিসমিল্লাহ পড়বে, কিয়ামতের দিন সে জাহান্নামের ১৯ জন ফেরেশতা হতে নিরাপদ থাকবে। (সূত্র: দুররে মানসুর-৯/১)
এছাড়াও হাদিসে খানা-পিনা, কাপড় পরিধান, (বিশেষ প্রয়োজনে) কাপড় খোলা, ঘরে প্রবেশ, ঘর থেকে বের হওয়া, অজু করা, স্ত্রী-সহবাস, যানবাহন বা নৌকায় আরোহণ, সকল দোয়ার শুরু ইত্যাদি সকল কাজে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করার কথা বর্ণিত হয়েছে।