স্পেনে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
মুহাম্মদ ইবরাহীম হোসাইন
স্পেনের পরিচিতি
মধ্যযুগীয় ইউরোপের অগ্রযাত্রায় স্পেনই পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। স্পেন তিনদিকে সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিতে। পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে জিব্রাল্টার প্রণালী ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর। স্পেনের সাথে ফ্রান্সের যে ভূখণ্ড সংযোগ রক্ষা করেছে তা হচ্ছে পিরেনীজ পার্বতমালা যা প্রায় তিনশত মাইল পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত। স্পেনের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমের উপকূল পর্বতমালা দ্বারা আবৃত থাকলেও এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তারাগোনা, কাসটেলন ভ্যালেসিয়া প্রভৃতি সমৃদ্ধশালী সমুদ্রপথ ছিল। স্পেনের মধ্যবর্তী অঞ্চলটি মেসেটা নামে পরিচিত।
ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাংশে অবস্থিত স্পেন আইবেবিয়ান উপদ্বীপের ৮৫ ভাগ ভূমি দখলকরে আছে। স্পেনের বর্তমান আয়তন ১,৯৪,৯০০ বর্গমাইল বা ৫,০৪,৭৮২ বর্গকিলোমিটার, স্পেন মুসলিম আমলে আন্দালুস নামে পরিচিত ছিল।
স্পেনে মুসলমানদের আগমনের পটভূমি
গথিক রাজাদের অধীনে প্রায় ৩০০ বছর, স্পেনে জনগণের কোনো কল্যাণ হয়নি বরং তারা ছিল নানা সমস্যায় জর্জরিত। শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচারে ভূমিদাস, ক্রীতদাস, বর্গাদার ও ইহুদিদের মধ্যে করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় রাজনৈতিক অবস্থা এক চরম পর্যায় উপনীত হয়। এরূপ নাজুক ও ভয়াবহ অবস্থায় উমাইয়া বংশের শ্রেষ্ঠ খলিফা আলওয়ালিদের শাসনামলে স্পেনের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অভিযান পরিচালিত হয়। এ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ ও মুসা বিন নুসাইর। মুসলমানদের অভিযানে আগমনের পূর্বে স্পেনে কেন্দ্রীয় শাসন ছিল খুবই দুর্বল। রাজ পরিবারগুলোর মধ্যে গোত্রীয় কলহ, যা সমগ্রিকভাবে রাজনৈতিক অবস্থাকে দুর্বিষহ করে তোলে। মুসলিম বিজয়ের পূর্বে গথিক রাজা রডারিক পূর্ববর্তী রাজা উইটিজাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে, ফলে উইটিজার ভ্রাতা, পুত্র, জামাতা সবাই বিরোধী হয়ে ওঠে।
অপরদিকে কাউন্ট জুলিয়ানের কন্যা ফোরিন্ডা রাজা রডারিক কর্তৃক শ্লøীলতাহানির শিকার হন, যার ফলে কাউন্ট জুলিয়ান রাজা রডারিকের প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম গভর্নর মুসা বিন নুসাইরকে স্পেন আক্রমণের আহŸান জানায়। তবে মুসলমানদের স্পেনে আগমনের ক্ষেত্রে তৎকালীন ধর্মীয়ব্যবস্থাও অনেক সুযোগ করে দিয়েছিল। তৎকালীন স্পেনের রাজা আদেশ জারি করেছিল যে, ইহুদিগণ হয় খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করবে, নতুবা স্পেন ত্যাগ করবে। অন্যথায় তাদেরকে হত্যা করা হবে। এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, ৬১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রায় ৯০ হাজার ইহুদিকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়।
স্পেন বিজয়ের বিবরণ
প্রথম অভিযান হলো সিউটার গভর্নর কাউন্ট জুলিয়ান ও উত্তর আফ্রিকার স্পেনীয় উদ্বাস্তুদের অনুরোধে মুসা বিন নুসাইর স্পেনের প্রাথমিক অবস্থা জরিপের জন্য অধিনস্ত সেনানায়ক তারিক বিন যিয়াদকে ৭১০ খ্রিষ্টাব্দে চারখানা যুদ্ধজাহাজে স্পেনে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তারিক কার্য সমাধা করে প্রত্যাবর্তন করেন এবং অভিযান পরিচালনার অনুকূলে রিপোর্ট পেশ করেন।
দ্বিতীয় অভিযান হলো উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা ও সামরিক অধিনায়ক মুসা ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে সাতহাজার সৈন্যর একটি বাহিনী দ্বিতীয় বারের মতো স্পেন বিজয়ের প্রেরণ করেন। পরবর্তীকালে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে বারো হাজারে পৌঁছে। কাউন্ট জুলিয়ান কর্তৃক প্রেরিত চারটি জাহাজে তারিক জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে স্পেনের পার্বত্য অঞ্চলে অবতরণ করেন। তবে তারিক যে স্থানে ঘাটি স্থাপন করছিলেন তা আজও জাবালুত তারিক নামে পরিচিত। তিনি আন্দালুসিয়ার দক্ষিণাঞ্চল দখল করেন। অতপর ৭১১ সালে ১৯ জুলাই মূলবাহিনী রডারিকের একলাখ সৈন্যর মোকাবিলা করে ওয়াদী লাস্কের নিকটবর্তী সারিস বা জেরেখে মুসলিম ও গথিক বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধ ইতিহাসে ওয়াদী লাস্কের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধ রাজা রডারিক শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হন। এ অভিযানে স্পেনের ভবিষ্যৎ রাজধানী কর্ডোভার এবং মূল রাজধানী টলেডোর পতন ঘটে।
সেনাধ্যক্ষ মূসা ও তারিকের যৌথ অভিযান
মূসা ৭১২ সালে তারিকের অধিকৃত অঞ্চল ব্যতিরেকে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের খ্রিষ্টান অধ্যুষিত শহরগুলোর দিকে অভিযান প্রেরণ করেন। তিনি তার আঠারশত সৈন্যসহ অতি সহজে মেদিনা, সেভিল, মেরিদা দখল করেন। এরপর তারিক ও মূসার সম্মিলিত বাহিনীর অভিযানে লিও, গ্যালিসিয়া ও ্যসরারগোসা মুসলিম অধিকারে আসে, তারপর তারা আরাগানে উপস্থিত হয়ে লিজিও আমিয়া অধিকার করেন। মাত্র দুই বছরে সমগ্র স্পেনে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা রডারিকের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে স্পেনে মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তারের পর অল্পদিনের মধ্যে স্পেন দামেস্কের উমাইয়া খেলাফতের অধীনে চলে আসে। অবশেষে এভাবে ধারাবহিক ভাবে স্পেনে খলিফাগণ খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এবং ৭৫০ সালে জাবের যুদ্ধের মাধ্যমে আব্বাসীয়দের হাতে উমাইয়াদের পতন হলে, আব্বাসীয় খেলাফতের প্রথম দিকে আব্দুর রহমান আদদাখিল নামক এক ব্যক্তি দামেস্ক থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে গিয়ে স্পেনে আশ্রায় গ্রহণ করেন। এবং সেখানে তিনি অবস্থান করার পর ¯^াধীনভাবে আবার উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন, অবশেষে ধারাবাহিকভাবে ১০৩১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তা চলতে থাকে। এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হলে স্পেনে মুসলিম আধিপত্য চলতে থাকে।
লেখক
প্রশিক্ষণ সম্পাদক
ইশা ছাত্র আন্দোলন
বরিশাল জেলা