রাসূলুল্লাহ সা. এর জিহাদ ও বিশ্বব্যাপী তার রাজনৈতিক প্রভাব
মাওলানা আবদুর রাজ্জাক
ইসলামী আন্দোলের কর্মীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সবক
১. ইসলামী আন্দোলনে আমীরের আনুগত্য
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের যে বিপর্যয় ঘটেছে তার পেছনে মুনাফিকদের চালবাজি ও কলাকৌশলের প্রভাব ছিল। এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সে সঙ্গে মুসলমানদের যে দুর্বলতাটা স্বীকার করতে হয় তা হলো মুসলিম মুজাহিদরা যুদ্ধের এক পর্যায়ে আনুগত্যহীন হয়ে পড়েছিল। এখান থেকে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে সার্বক্ষণিক আমীরের আনুগত্যের সবক নিতে হবে।
২. ইসলামী আন্দোলনের প্রাণশক্তি
দুনিয়ার যে কোন আন্দোলন-সংগ্রামে তার প্রাণবস্তু বা চালিকা শক্তিরূপে একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তি থাকতে হয়। কিন্তু আদর্শবাদী কোন আন্দোলনের সমৃদ্ধি ও স্থায়িত্ব কোন ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং যে নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে এ আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত ও চালিত হয় তার দৃঢ়তা ও সত্যতার ওপরই এর সবকিছু নির্ভর করে। ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের জন্য নবীদের ব্যক্তিত্ব অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্তে¡ও এর উন্নতি ও স্থায়িত্ব সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হলো ইসলামের উপস্থাপিত নীতিমালা ও নবীজীর আদর্শের ওপর। এ কারণে উহুদ যুদ্ধে নবীজী সা. এর শাহাদাতের ভুল সংবাদ প্রচার হওয়ার পর যখন সাহাবায়ে কেরামের মাঝে কিছুটা হতাশা দেখা দিলো তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কালামে পাকের আয়াত নাযিল করে মুসলিম মুজাহিদদের জানিয়ে দিলেন “মুহাম্মদ সা. একজন আল্লাহর রাসূল মাত্র। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি তিনি মারা যান অথবা নিহত হন তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ পদর্শন করবে? আর কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে আল্লাহর ক্ষতি করবে না। আল্লাহ শীঘ্রই তার কৃতজ্ঞ বান্দাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। (সূরা আলে ইমরান- ১১৪)
৩. আল্লাহর পক্ষ থেকে কর্মীদের সান্তনাবাণী
হযরত সাহাবায়ে কেরাম যখন জানতে পারলেন নবীজী সা. এর শাহাদাতের খবর সত্য নয়, তখন তারা পুনরায় সর্বশক্তি নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। একপর্যায়ে কাফেররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। যুদ্ধ শেষে যখন দেখা গেলো, ৭০জন সাহাবী শাহাদাত বরণ করেছিলেন।
তাদের শাহাদাতে সকল মুসলমান মর্মাহত হয়েছিলো। তাই কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করে তাদেরকে সান্ত¦না দিয়ে বলছেন “তোমরা হীনবল হয়োনা এবং দুঃখিতও হয়োনা। তোমরাই জয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও।”
“যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে অনুরূপ আঘাত তো তাদেরও লেগেছিলো।”(সূরা আলো ইমরান-১৩৯-১৪০)
৪. মৃত্যুভয়ই সকল র্দ্বুলতার উৎস
মানুষের সমস্ত দুর্বলতার উৎস হচ্ছে মৃত্যু ভয়। তাই এ সময়ে মুসলমানদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হলো যে, তোমাদের মৃত্যুভয়ে পলায়ন অর্থহীন। কারণ মৃত্যুর জন্য নির্ধারিত সময় না আসা পর্যন্ত কোন প্রাণীরই মৃত্যু হতে পারে না।
৫. জিহাদ হবে একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ পালনের নিয়তে
যদি কেউ গণিমতের মাল অর্জনের জন্য জিহাদে শরীক হয়, সে গণিমতের মাল থেকে কিছুতো পাবেই কিন্তু কোন প্রতিদান পাবে না। এর বিপরীতে যদি বিশুদ্ধ নিয়তে আল্লাহর নির্দেশ পালন করার উদ্দেশ্যে জিহাদ করে, তবে সে পরকালে পুরস্কৃত হবে এবং গণিমতের সম্পদ থেকেও অংশ পাবে।
উল্লেখিত সবকগুলোর শেষ দু’টিকে কালামে পাকে এভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। “আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কারো মৃত্যু হতে পারে না, যেহেতু এর সময় অবধারিত। কেউ পার্থিব পুরস্কার চাইলে আমি তাকে কিছু দেই এবং কেউ পরলৌকিক পুরস্কার চাইলে আমি তাকে তার কিছু দেই। আর যারা শোকরগুজার তাদেরকে আমি শীঘ্রই তাদের পুরস্কার দান করবো।”(সূরা আলে ইমরান-১৪৫)
৬. শত্রুর শ্লোগানের জবাব শ্লোগান
যুদ্ধ শেষ হবার পর কাফিরদের নেতা আবু সুফিয়ান তার দেশীয় হুবল নামক মুর্তির নাম নিয়ে শ্লোগান দিলো “হুবলদের জয়, হুবলদের জয়” নবীজী সা. হযরত উমর রা. কে তার জবাবে আল্লাহর নামে শ্লোগান দিতে আদেশ করলেন। তিনি জবাব দিলেন, “আল্লাহই সবচেয়ে বড় ও সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী।
৭. জাতীয়তার জন্য যুদ্ধ করলে শহীদ হয় না
উহুদ যুদ্ধে ‘কুযমান’ নামক এক ব্যক্তি বড় দক্ষতার সাথে লড়াই করে, আশ্চর্যপূর্ণ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছে। সে একাই ৮জনকে হত্যা করে মাটিতে পড়ে যায়। তাকে যখন ধরাধরি করে নিয়ে আসা হয়, তখন এক সাহাবী তাকে সুসংবাদ প্রদান করলেন। তখন কুযমান বললো যে, আমাকে কিসের সুসংবাদ শুনাচ্ছো? আমি তো স্ব-জাতির সম্মান বজায় রাখতে যুদ্ধ করেছি। যখমের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে লোকটি পরিশেষে আত্মহত্যা করে বসে। রাসূল সা. বললেন, লোকটি জান্নামি। কারণ সে সবর করেনি এবং তার উদ্দেশ্য দীন ছিলো না।
উহুদ যুদ্ধে বিপর্যয় আরো কিছু কারণ ও হেকমত
১. ঝগড়া ও বিতর্কে লিপ্ত হওয়া
২. সাহস হারা হওয়া
আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহ তোমাদের সাথে তার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন যখন তোমরা আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে হত্যা করেছিলে। যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারালে এবং হুকুম স¤^ন্ধে মতভেদ সৃষ্টি করলে এবং তোমরা যা ভালবাসো তা তোমাদেরেেক দেখাবার পর তোমরা অবাধ্য হলে।”(সূরা আলে ইমরান-১৬২)
৩. ঈমানের ক্ষেত্রে কাঁচা-পাকা, সত্যবাদী-মিথ্যাবাদীর পার্থক্য করার জন্য ভালবাসার দাবী করলে বিপদাপদ সহ্য করতে হয়। আল্লাহ তার প্রেমিকদের পরীক্ষা নেয়ার জন্য পরাজয় দান করলেন।
৪. “প্রিয় বান্দাদেরকে শাহাদাতের অমীয় শুধা পান করিয়ে আপন করে নেয়ার জন্য মানুষের মধ্যে এইদিনগুলো পর্যায়ক্রমে আমি আবর্তন ঘটাই। যাতে আল্লাহ মুমিনদেরকে জানতে পারেন এবং তাদের মধ্য থেকে কতককে শহীদরূপে গ্রহণ তরতে পারেন এবং আল্লাহ জালেমদেরকে পছন্দ করেন না।”(সূরা আলে ইমরান-১৪০)
৫. মুসলমানরা যেন এই শাহাদাত ও পরাজয়ের মাধ্যমে নবীজী সা. এর হুকুম অমান্য করার গুণাহ থেকে পরিষ্কার হতে পারে।
৬. আল্লাহ তার শত্রুদের স্বমূলে নির্মূল করার জন্য
যখন আল্লাহ তাআলার বন্ধুসমাজ শত্রæদের দ্বারা আক্রান্ত হবে তখন বন্ধুদের রক্তনদী দেখে আল্লাহর রহমতের নদীতে উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি হবে। এর ফলে শত্রæদের সমূলে নির্মূল করে দিবেন।
“আর উদ্দেশ্য (এও) ছিলো, যাতে আল্লাহ মুমিনদের পরিশোধন করতে পারেন। এবং কাফিরদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেন।”(সূরা আলে ইমরান-১৪১)
৭. যেন একথা সকলের জানা হয়ে যায় যে, আল্লাহ তার নিয়ম একই ধরণের রাখে না বরং কখনো বন্ধুকে সাহায্য করেন আর কখনো শত্রুকে “আমি এ দিনগুলোকে মানুষের মাঝে আবর্তন করে থাকি” তবে শেষ পরিণতি মুমিন-মুসলমানদের পক্ষে। “আল্লাহভীরুদের জন্যই রয়েছে শুভ পরিণাম।”
৮. আত্মগর্ব থেকে মুক্ত রাখার জন্য মুমিনদেরকেও মাঝে মাঝে পরাজয় দান করেন।
৯. ভগ্ন হৃদয়ে আল্লাহর নিকট বিনয়ের সঙ্গে প্রার্থনা করে করে নিজেদের মান-মর্যাদা যাতে বুলন্দ করতে পারে।
১০. মুমিনগণ যাতে এ কথা বুঝে নিতে পারেন যে, চরম পরিশ্রম ও পূর্ণ সাধনা ব্যতীত উচ্চ মর্যাদা ও সমুন্নত অবস্থান লাভ করা সম্ভব নয়। “তোমরা কি মনে কর, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি, তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে এবং কারা দৃঢ়পদ।”(সূরা আলে ইমরান-১৪২)