শহীদদের রক্ত আজও আমায় কাঁদায়
-আহমদ আবদুল কাইয়ুম
১৫ আগস্ট ২০০২। ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। কেননা সেদিন ক্ষমতায় থাকা ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী সরকারের হিংস্র আঘাতে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হাফেজে কুরআন মাদরাসা ছাত্রদের নির্মমভাবে শহীদ হতে হয়েছে। ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে ইসলামের ধারক-বাহক হাফেজে কুরআন ও আলেমদের খুন করে কি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল তারা? আল্লাহর ঘর মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদ করা কি অপরাধ? একটি মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। ঘটনার স্থল রাজধানী ঢাকার মালিবাগ টিএন্ডটি বায়তুল আজিম জামে মসজিদ। যা বর্তমানে শহীদী মসজিদ নামে নামকরণ করা হয়েছে। বিরানব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে আল্লাহর ঘর মসজিদ ভেঙ্গে তদস্থলে মার্কেট নির্মাণ করার দুঃসাহস মেনে নেয়নি আদর্শিক কাফেলা ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন। সেদিন ইশা ছাত্র আন্দোলন ছাড়া মাঠে প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না। দেশে জোটের রাজনীতির চর্চার কারণে ইসলামপন্থি সংগঠনগুলো জোটে সম্পৃক্ত থাকায় আল্লাহর ঘর মসজিদ ভাঙ্গার মত মহা অপরাধের প্রতিবাদটুকুও তারা করতে পারে নি। অপরদিকে নো আওয়ামীলীগ, নো বিএনপি ইসলাম ইজ দ্যা বেস্ট, এই নীতিতে বিশ্বাসী ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন কারো কাছে মাথা বিক্রি করেনি। সেজন্য তাদের কাউকে জমা-খরচও দিতে হয় না। সকল সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচ- প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে আদর্শিক কাফেলা ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন। আর সে কারণেই আল্লাহর ঘর মসজিদ ভেঙ্গে মার্কেট নির্মাণ করার স্বপ্ন বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়নি সংগঠনটি। আল্লাহর বাণী, “যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘর মসজিদসমূহে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে বাধা দেয় এবং সেগুলোকে উজার করার চেষ্টা করে তার চাইতে বড় অত্যাচারী আর কে?’’
(সূরা বাকারা- ১১৪)
কুরআনে বর্ণিত নির্দেশ জালিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে শহীদী কাফেলা ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের কর্মী শহীদ হাফেজ আবুল বাশার, শহীদ রেজাউল করীম ঢালী, শহীদ ইয়াহইয়া, শহীদ জয়নাল আবেদীনকে নির্মমভাবে খুন হতে হয়। আনসারের গুলিতে আহত হয় আরো ৬০জন। মসজিদ রক্ষার আন্দোলনে গুলি চালিয়ে শহীদ করার ঘটনা বিশে^ বিরল। অথচ ইসলামী মূল্যবোধের ধ্বজাধারী বিএনপি ও দলীয় সন্ত্রাসীর গুলিতে এই হত্যাকা- মুসলিম উম্মাহকে মর্মাহত ও ব্যথিত করেছে। ইতিহাসে মুসলমান কেন, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও এমন ঘটনা বিরল। পরস্পর হিংসাপরায়ণ ও বিরোধপূর্ণ হয়ে নিজেদের উপাসনালয় ভেঙ্গে দিয়েছে। এর আগের সরকার (আওয়ামীলীগ) ফতোয়াকে কেন্দ্র করে বি-বাড়ীয়ায় আটজন হাফেজে কুরআনকে শহীদ করেছে। শহীদ হাফেজদের রক্তের উপর পা দিয়ে ২০০১ সালে ইসলামী মূল্যবোধের সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে শহীদের খুনের বিচার না করে আরো চারজনকে শহীদ করে দেশবাসী বিশেষ করে ইসলামী জনতাকে মর্মাহত করেছে।
১৫ আগস্ট ২০০২ বৃহস্পতিবার মসজিদ রক্ষার দাবীতে অনুষ্ঠিতব্য মালিবাগের সামনে পুলিশ ও আনসারের গুলিতে শহীদ হওয়ার ঘটনায় আমি কয়েকজন সাথীকে নিয়ে মালিবাগ ঘটনাস্থলে গিয়ে শহীদদের না দেখলেও তাদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত এ দৃশ্য দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে চার শহীদের লাশ দেখে চোখের পানি সংবরণ করতে পারিনি। রক্তমাখা জামাসহ লাশের প্রতিচ্ছবি আজো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আর লাশ থেকে বেহেস্তের খুশবু আজো আমাকে নাড়া দেয়। আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় হযরত সাহাবায়ে কিরামের কথা। তাদের তাঁজা রক্তে আজো দীন টিকে আছে। মহান আল্লাহর বাণী, “যারা আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করে তাদেরকে মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত। তোমরা তা বুঝতে পার না।” (সূরা আল বাকারা)
আসলেই সেদিন শহীদদের লাশ দেখে মনে হয়নি তাঁরা মৃত। তাদের চেহারা আলোকিত ও হাস্যোজ্জ্বল। মনে হয় তাঁরা ঘুমিয়ে আছে। শহীদ ভাইদের কথা মনে হলে আজও নিরবে আত্মা কেঁদে উঠে, অশ্রুসিক্ত হয়ে যায় মন, তখন ঠিক থাকতে পারি না। যারা আমাদেরকে ঋণী করে রেখেছে তাদের জন্য যখন কিছু করা না যায় তখন ব্যথিত ও মর্মাহত না হয়ে পারি না। শহীদদের জন্য আমাদের করার কিছু আছে। আর তা হলো শহীদী তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে দীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা আরো শাণিত করা। মসজিদ রক্ষার আন্দোলনে শাহাদাত বরণকারী চার শহীদের ঘটনায় পুরো মুসলিম উম্মাহ ব্যথিত হলেও জোটভুক্ত উলামায়ে কিরামের মধ্যে কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় নি। তার কারণ ছিল ক্ষমতার মোহ বা লোভ। মন্ত্রীত্ব পাবার লোভ। কিন্তু আফসোস, আজ তাদের মুখ থেকে বের হয় “হক্বের পতাকাবাহী ও আদর্শিক পরিবর্তনের রূপকার পীর সাহেব চরমোনাই” সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য। পীর সাহেব চরমোনাই নাকি দিনে সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করে আর রাতে সরকারের সাথে বৈঠক করেন। আমি জানি না, এমন মন্তব্য তারা নিজেদের স্বভাব-চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের আলোকে করেন কিনা। তবে মিথ্যা ধারণা করা নেহায়েত অন্যায়।
একথা সত্য, সংগঠন যত বড় হবে তার বিরুদ্ধে তত অপপ্রচার বাড়বে। কেননা, হিংসুকরা জ¦লে-পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন দেশের সর্বস্তরের ছাত্র জনতা, পেশাজীবী মানুষ এই কাফেলায় শরীক হচ্ছে। ঘটনার পরদিন ১৬ আগস্ট ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্রের উদ্যোগে গণজমায়েত ছিল রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে। তাতে হযরত পীর সাহেব চরমোনাই (রহ.) প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছিলেন। সেখানে তিনি জোট সরকারের কাছে চার দফা দাবী পেশ করেছিলেন। ১. খুনী তৌফিক, ছাত্রদল নেতা হানিফসহ খুনিদের গ্রেপ্তার করে অবিলম্বে বিচার, ২. খালেদা জিয়াকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা, ৩. সরকারী জায়গায় যত মসজিদ আছে ঐ সকল জায়গাকে মসজিদের নামে ওয়াক্ফকরণ এবং ৪. শহীদ পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু কোন দাবীই মানেনি জোট সরকার। মসজিদের নির্মাণ কাজ করলেও তা বন্ধ। দীর্ঘ কয়েক বছরেও মসজিদের কাজ সম্পূর্ণ করতে পারেনি।
শহীদ হাফেজ আবুল বাশারের পরিচয়
নাম- হাফেজ আবুল বাশার। পিতা- হাফেজ আব্দুস সাত্তার। গ্রামের বাড়ি- পিরোজপুর সদর থানার খলিশাখালী। পাঁচভাই একবোনের মধ্যে সে বড়। তার মাও একজন হাফেজা। আবুল বাশার ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের জনশক্তির দ্বিতীয় পর্যায়ের অর্থাৎ কর্মী ও খিলগাঁও থানার দায়িত্বশীল ছিল। ছাত্র আন্দোলনের সকল কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার কারণে সকলেই তাঁকে ভালোভাবে চিনত। শহীদ হওয়ার পর তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের তৎকালীন মুহতারাম মহাসচিব মাও. নূরুল হুদা ফয়েজী ও ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতৃবৃন্দ সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
হাফেজ আবুল বাশার মালিবাগ মাদ্রাসার মেধাবী ছাত্র ছিল। ইসলামী আন্দোলনের বই পড়া ছিল তাঁর নেশা। লেখালেখির প্রতি ছিল প্রচ- ঝোঁক। শহীদ আবুল বাশারের পুরো পরিবারই আলেম পরিবার। তাঁর ৪ভাই হাফেজ। বোনও মাদরাসায় পড়ুয়া। শহীদ হওয়ার পর শহীদ বাশারের মা-বাবার অনুভুতি আমাদের যুগিয়েছে নতুন প্রেরণা।
পিতার অনুভূতি
শহীদ আবুল বাশারের পিতা হাফেজ আব্দুস সাত্তার বলেন, “আল্লাহ তা’য়ালা আমার ছেলেকে শহীদ হিসেবে কবুল করেছেন এর চাইতে সৌভাগ্য আর কি হতে পারে? তিনি বলেন, আবুল বাশার অত্যন্ত ন¤্র-ভদ্র ও খোশ মেজাজের ছিল। তাকে নিয়ে আমার গর্ব হয় যে, আল্লাহর ঘর মসজিদ রক্ষার আন্দোলনে সে শহীদ হয়েছে। আমি আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাই। শহীদদের রক্তের পথ ধরে এদেশে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হবে এ প্রত্যাশা করছি। আমি শহীদ আবুল বাশারের জন্য জালিম সরকারের কাছে কোন বিচার চাই না, আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। তিনি ছাত্র আন্দোলনের ভাইদের উদ্দেশ্যে বলেন, আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করতে হলে রক্ত দেয়া ও রক্ত নেয়ার কোন বিকল্প নেই। তিনি শহীদদের পথ ধরে দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করার জন্য সকলকে আহ্বান জানান। শহীদ আবুল বাশার ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হওয়ায় তিনি শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন।”
মায়ের অনুভূতি
শহীদ হাফেজ আবুল বাশারের মা বলেন, “আবুল বাশার আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেল। আবুল বাশার বাড়ি থেকে আসার সময় বলেছিল, আমার হয়তো আর বাড়িতে আসা হবে না। তার মা বলল, তুমি কি বলছ? তখন বাশার বলল, মা আমি পরবর্তীতে যখন আসব তোমার গর্বিত সন্তান হয়ে আসব। তার কথা অনুযায়ী ঠিক সে গর্বিত সন্তান হয়েই বাড়িতে ফিরে গেছে। তাঁর মা বলেছিল, তাহলে কি আমার বাশার আল্লাাহর পক্ষ থেকে এভাবে কোন ইঙ্গিত পেয়েছিল। প্রকৃত শহীদরা কি এভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে ইশারা পেয়ে থাকে? তিনি পীর সাহেব চরমোনাই’র সাথে বাশারের সম্পৃক্ততা থাকায় গর্ববোধ করেন। তেমনিভাবে তাঁর ভাই-বোনেরাও শহীদের ভাই ও বোন হিসেবে পরিচয় দিতে পেরে শুকরিয়া প্রকাশ করেন এবং সহযোগীতা ও খোঁজ খবরের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। ছাত্র আন্দোলনের এই শহীদী কাফেলাকে মনজিলে মকসুদে নিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান।”
শহীদ রেজাউল করীমের পরিচয়
নাম- মুহাম্মাদ রেজাউল করীম ঢালী। পিতা- আব্দুল আউয়াল ঢালী। গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানার শ্রীনগর গ্রামের ঢালী বাড়ি।
শহীদ রেজাউল করীম ঢালী ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের সদস্য ছিল। সদস্য হয়েও ছাত্র আন্দোলনের প্রায় সকল কর্মসূচিতে সে নিয়মিত অংশগ্রহণ করত। শহীদ হওয়ার পর তাঁর গ্রামের বাড়িতে আন্দোলনের তৎকালীন আমীর পীর সাহেব চরমোনাই রহ., অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন, তৎকালীন দায়িত্বশীল মুফতি নূর হোসাইন নূরানী, আমি, সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ নেছার উদ্দিন ভাইসহ কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতৃবৃন্দ গিয়ে শহীদ রেজাউল করীমের কবর যিয়ারত করি। তাঁর মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনকে সান্ত¡না দেই এবং তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে শহীদ রেজাউল করীম স্মৃতি সংসদ ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন হযরত পীর সাহেব রহ.। শহীদ রেজাউল করীম চৌধুরীপাড়া মাদ্রাসার মেধাবী ছাত্র ছিল। শহীদী তামান্না ছিল তার হৃদয়ে জাগ্রত। তাঁর পুরো পরিবারে একমাত্র মাদরাসা পড়–য়া ছিল সে-ই। রেজাউল করীমরা দুই ভাই-বোন। সে ভাই বোনদের মধ্যে সবার ছোট। বড় আলেম হওয়ার আকাক্সক্ষা নিয়েই মাদরাসায় পড়তে এসেছিল। সে নাহবেমীর জামাতের ছাত্র ছিল।
বাবার অনুভূতি
শহীদ রেজাউল করীম ঢালীর পিতা আব্দুল আউয়াল ঢালী বলেছিলেন, আমার ছেলেকে আল্লাহর পথে দিয়েছিলাম। আল্লাহর পথে নেমে তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছে এতে দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই; বরং আমি গর্বিত। পীর সাহেব চরমোনাই’র নেতৃত্বাধীন ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের সদস্য হওয়ার কথা শুনে তিনি খুশি হন এবং তিনি বলেন, একজন আল্লাহওয়ালা ব্যক্তির সংগঠনে থেকে আমার রেজাউল খাঁটি মানুষ হতে পেরেছিল। পীর সাহেব চরমোনাইসহ ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তার বাড়িতে যাওয়ায় তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
মায়ের অনুভূতি
রেজাউলের মা বলেছিলেন, ঘটনার ২দিন পূর্বে তার ছোট চাচাতো ভাইকে কোলে নিয়ে বলল, ভাইয়া আমি যদি শহীদ হয়ে যাই তুমি কি কান্না করবে? ছোট ভাই বলল, হ্যাঁ আমি কান্না করব। এ কথাগুলো তাঁর মা শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে, রেজাউল তুমি কি বলছ, রেজাউল বলে, হ্যাঁ মা আমি শহীদ হয়ে যেতে পারি। আমাদের মাদরাসার পাশে একটি মসজিদ সন্ত্রাসীরা বন্ধ করে দিয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার সে মসজিদ উদ্ধারের আন্দোলনে যাবো। মা তুমি কি কাঁদবে? মা, তুমি কাঁদলে আমার শহীদী আত্মা কষ্ট পাবে। এ বলে সে ঘটনার আগের দিন বাড়ি থেকে মা-বাবাসহ সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে। তার মা কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আবার শান্ত হয়ে শুকরিয়া আদায় করেন। তিনি বলেন, আল্লাহর ঘর মসজিদের জন্য আর যেন কাউকে প্রাণ দিতে না হয়। আমাদের রেজাউলের জন্য দোয়া করবেন।
এছাড়াও হাফেজ ইয়াহইয়াও মালিবাগের ছাত্র ছিল। তার বাবা একজন প্রখ্যাত আলেমেদীন। আটভাই ও বোনদের মধ্যে সে ছিল তৃতীয়। ইয়াহইয়া মেধাবী ছাত্র ছিল। তাঁর গ্রামের বাড়ি মোমেনশাহী জেলার ফুলপুর থানার বড়ইকান্দি গ্রামে। জেলা নেতৃবৃন্দ অভিভাবকের সাথে সাক্ষাত করে খোঁজ খবর নিয়েছেন। শহীদ জয়নুল আবেদীন ছিল নিতান্ত খেটে খাওয়া মানুষ। মেয়ের বিয়ের তারিখ ছিল ২০আগস্ট। একমাত্র মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় করতে ঢাকায় আত্মীয়-স্বজনদের কাছে এসেছিল সাহায্যের জন্য। ঘটনার দিন মালিবাগ এসেছিল তার ভায়রা ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত করতে। কিন্তু ঘাতকদের বুলেট তাকেও রেহাই দেয়নি। বিয়ের টাকার পরিবর্তে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন জয়নাল। জয়নালের গ্রামের বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার উত্তর ডুমুরিয়ার মাঝি বাড়ি গ্রামে। তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে শোকাহত পরিবারের সাথে তৎকালীন দায়িত্বশীল মুফতী নূর হোসাইন নূরানী ও আমিসহ জেলা আন্দোলন ও ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ দেখা করেছি। শহীদ জয়নুল এর পরিবারকে সান্ত¡না দিয়ে তাদের খোঁজ খবর নিই এবং নগদ আর্থিক সহযোগিতাসহ তাঁর মেয়ের বিয়ের খরচ বহন ও ছেলেদের লেখা-পড়ার দায়ভার গ্রহণের ঘোষণা করেন মুফতি নূরানী সাহেব।
সবশেষে বলা যায়, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের শাহাদাতের মধ্য দিয়ে দেশবাসী ও সচেতন ছাত্রদের কাছে এই মেসেজ ও শিক্ষা দেয়া হয়েছে, দীনকে বিজয়ী করতে হলে শহীদী তামান্না বুকে লালন করে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
আন্দোলনের এ পথ ভোগের নয়, ত্যাগের। আরামের নয়, কষ্টের। এই ধারাবাহিকতা ঠিক রাখতে পারলে এই কাফেলা একদিন মনজিলে মকসুদে পৌঁছবেই, ইনশাআল্লাহ। শহীদদের পথ ধরে আমরাও যেন জীবন ও রক্ত দিতে পারি সে তামান্না রাব্বুল আলামীনের দরবারে। আমিন।
লেখক-
সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি (২০০২-২০০৩ সেশন)
ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন।