বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আয়াত নং ০১
“সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআ’লার জন্য যিনি সমস্ত জাহানের প্রতিপালক।”
ভূমিকা
সূরায়ে ফাতিহা কুরআনুল কারীমের সর্বপ্রথম নাযিলকৃত পূর্ণাঙ্গ সূরা। সূরায়ে ফাতিহার পূর্বে বিচ্ছিন্ন কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কোন সূরা অবতীর্ণ হয় নি। সূরায়ে ফাতিহার মাহাত্ম, গুরুত্ব ফজীলত অনেক। এর গুরুত্ব ও ফজীলত সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। স্বয়ং কুরআনে ভিন্ন নামে “সাব’য়ে মাছানী” তার আলোচনা এসেছে। ‘আল ইতকার ফি উলূমিল কুরআনে’ সূরায়ে ফাতিহার বিশের অধিক নাম উল্লেখ করেছে। অধিক নামের দ্বারা তার মর্যাদার আধিক্যই বুঝা যায়। ফাতিহার ফাতিহা নাম করণের কারণ হলো-ফাতিহা অর্থ উন্মোচনকারী। যেহেতু সূরায়ে ফাতিহা কুরআনুল কারীমের শুরতেই অবস্থিত এবং তার মাধ্যমেই কুরআনুল কারীমকে উন্মোচন করা হয়, তাই তাকে ফাতিহা বলে নামকরণ করা হয়েছে। তাকে কুরআনের মূলও বলা হয়েছে। তার কারণও আমরা গত সংখ্যায় উল্লেখ করেছি যে, গোটা কুরআনুল কারীমের সারমর্ম বা মূল বক্তব্য সূরায় ফাতিহার মাঝে নিহীত। তাই তাকে উম্মুল কিতাব বা কুরআনের জননী বলা হয়েছে।
নাযিলের প্রেক্ষাপট
হযরত আবু মায়সারা রা. থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ সা. (রাস্তায়) বের হলেন, হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন, এক আহ্বানকারী আহ্বান করছে, হে মুহাম্মাদ! এই (অদৃশ্য) আওয়াজ শুনে তিনি ভয় পেয়ে চলে গেলেন। ওয়ারাকা ইবনে নওফল একথা শুনে হুজুর সা. কে বললেন, আবার যখন এই আওয়াজ শুনবেন, তখন দৃঢ়তার সহিত আপনাকে যা বলে তা শুনবেন। পরে যখন তিনি আবার বের হলেন, তখন শুনতে পেলেন হে মুহাম্মাদ! তখন তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, আমি উপস্থিত। তখন সেই আহ্বানকারী বললেন, আপনি বলুন, ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ আরও বলুন, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন…। আসবাবুন নুযূল
আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
আয়াতের সরল অনুবাদ আমরা উপরে উল্লেখ করেছি। তাতে বলা হয়েছে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআ’লার জন্য। অর্থাৎ নভোম-ল ও ভূম-ল যেখানেই কারও কোন প্রশংসা হোক না কেন, তার প্রকৃত হকদার বা অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তা’আলা। শুধু পৃথিবীতে নয়; এর বাইরের কোন জগতেও যদি কোন প্রশংসা হয়, তা আল্লাহ তাআ’লার জন্যই। যেমন আমরা কারও কোন ব্যক্তিগত কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তার প্রশংসা করি, তুমি অনেক ভাল করেছ। যদিও এখানে বাহ্যিক দৃষ্টিতে প্রশংসা ঐ ব্যক্তির করা হলো, মূলত প্রশংসাটি হয়েছে আল্লাহ তা’আলার। কারণ তাকে এমন সুন্দর কাজ করার যাবতীয় উপকরণ আল্লাহ তা’আলাই দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলার দয়া ও অনুগ্রহেই সে উক্ত কাজটি সম্পাদন করতে পেরেছে। যেমন, আমাদের দেশে বড় বড় সেতু, রাস্তা বা মিলফ্যাক্টরি তথা উন্নয়নমূলক অনেক কাজ হয়, যেগুলো সাধারণত শ্রমিকদের শ্রমে তৈরি হয়। যখন আমরা এসকল কাজের প্রশংসা করি তখন বলি, অমুক সরকার এই কাজটি করেছে। শ্রমিকের হাড়ভাঙা প্ররিশ্রমে তৈরি হলেও এখন প্রশংসাটা সরকারই পায়। কারণ সরকারের দেয়া যাবতীয় উপকরণ, বেতন-ভাতা ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিদার কারণেই শ্রমিক তা নির্মাণ করেছে। এই কারণে প্রশংসার অধিকারী সরকার হয়েছে। এখন যে সরকারের আমরা প্রশংসা করলাম এটিও মূলত আল্লাহ তা’আলার জন্য। আশা করি কারণ সবার নিকট স্পষ্ট। এতো গেলো ঐ সকল কাজ, যা মানুষ করে থাকে। আর যে সকল কাজে মানুষের কোন হাত নেই, সরাসরি আল্লাহ তা’আলার কুদরতেই হয়ে থাকে, তার প্রশংসার অধিকারী শুধুই তিনি। যেমন, আলো, বাতাস, পানি, বিভিন্ন ফল-ফলাদি, উদ্ভিদ ইত্যাদি একমাত্র তাঁর কুদরতেই হয়ে থাকে। তাই এর প্রশংসা কেবলই আল্লাহ ত’আলার জন্য। সুতরাং ভাল ফসল উৎপাদন হওয়া বা অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রকৃতি, দেব-দেবির গজে চড়ে আসা ইত্যাদির কোন সম্পর্ক নেই। সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্যই।
আল্লাহ এমন এক সত্তাকে বলা হয়, যার অস্তিত্য অতিআবশ্যক। যিনি সমস্ত পরিপূর্ণ গুণের অধিকারী। আল্লাহ শব্দটি মহান রাব্বুল আলামীনের স্বত্তাগত নাম। এছাড়াও তার অনেক গুণবাচক নাম রয়েছে। কেউ কেউ এর সংখ্যা ৪০০০ (চার হাজার) বর্ণনা করেছেন। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই একত্ববাদী জনগোষ্ঠীর মাঝে বিশ্বপ্রতিপালকের এককসত্তা বোঝানোর জন্য আল্লাহ শব্দটির প্রচলন রয়েছে। প্রাচীন সিমেটিক ভাষাগোষ্ঠীর প্রত্যেকটি শাখাতেই সামান্য পরিবর্তন ভেদে আল্লাহ শব্দটি এক, অদ্বিতীয়, অনাদী, অনন্ত উপাস্য সত্তার জন্য ব্যবহার হয়ে আছে। যেমন, প্রাচীন কালদানীয় ও সুরিয়ানী ভাষায় আল্লাহ শব্দটি আলাহিয়া, প্রাচীন হিব্রু ভাষায় উলূহ এবং আরবী-ভাষায় ইলাহরূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিবর্তিত আরবী ভাষায় ইলাহ শব্দের সাথে আরবী আল অব্যায় যুক্ত হয়ে আল ইলাহ বা আল্লাহ শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে। হুজুর সা. এর আগমনের পূর্বেও আরবদের মাঝে আল্লাহ শব্দটি মহান পরওয়ারদেগারের একক শব্দরূপে ব্যবহৃত হতো। আরবের ছাফা পর্বতের অনেক শিলালিপিতে আরবি আল্লাহ শব্দটি বহুপূর্ব থেকেই লেখা ছিলো এবং এখনও আছে। এ শব্দটির কোন স্ত্রীলিঙ্গ নেই। আল্লাহ শব্দটিকে কোনভাবে বিকৃত ঘটানোও সম্ভব নয়। কারণ আরবী ভাষায় এ শব্দটি লিখতে যে কয়টি অক্ষরের প্রয়োজন এবং যেকোন একটি অক্ষর বাদ দিয়ে দিলেও তা অবিকৃত থাকে এবং সঠিক অর্থ প্রকাশ করে।
রাব্বুল আলামীন: রব শব্দটি আল্লাহ তা’আলার একটি গুণবাচক নাম। কোন কোন উলামায়ে কিরাম একে ‘ইসমে আ’জম’ ও বলেছেন। (তাফসীরে কুরতুবী) এর দ্বারা আল্লাহ তা’আলার পবিত্রতা ও বড়ত্ব বর্ণনা করা হয়। পবিত্র কুরআনুল কারীমে এই শব্দটির আলোচনা এসছে প্রায় ৯০০ এর অধিক স্থানে। আম্বিয়ায়ে কিরাম আলাইহিমুস সালাম এবং নেক বান্দাদের অধিকাংশ দোয়া এই রব (রাব্বানা) শব্দ দ্বারা বর্ণিত হয়েছে। রব শব্দের শাব্দিক অর্থ লালনপালন করা, প্রতিপালন করা, মালিক, সর্দার ইত্যাদি। পারিভাষিকভাবে রব বলা হয়, ‘কোন বস্তুকে তার সমস্ত মঙ্গলামঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য রেখে ধীরে ধীরে বা পর্যায়ক্রমে সামনে অগ্রসর করে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দেওয়া’। -মা’আরেফুল কুরআন
রব শব্দটি আল্লাহ তা’আলার জন্যই ব্যবহার হয়। তবে ইযাফাত (সম্বন্ধ) এর সাথে আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়। যেমন, রাব্বুদ্দার (এই বাড়ির মালিক) ইত্যাদি। তার কারণ হলো, প্রত্যেকটি প্রাণী বা সৃষ্টিই প্রতিপালিত হওয়ার মুখাপেক্ষী, তাই সে অন্যের প্রকৃত প্রতিপালনের দায়িত্ব নিতে পারে না।
আমরা রবের যে পারিভাষিক অর্থ আলোচনা করেছি, এই অর্থের ব্যাপকতার কারণে আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. রাব্বুল আলামীন এর ব্যাখ্যায় রবের অনেকগুলো অর্থ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাব্বুল আলামীন অর্থাৎ সমস্ত জাহানের প্রতিপালক তার অর্থ হলো, ১. তিনি সমস্ত জাহানের ব্যবস্থাপক, ২. কর্তৃত্বশীল, ৩. সৃষ্টিকর্তা, ৪. রিযিকদাতা, ৫. বিধানদাতা, ৬. জীবনদাতা, ৭. মৃত্যুদাতা, ৮. মর্যাদাদাতা, ৯. লাঞ্ছনাকারী, ১০. দাতা, ১১. সঙ্কোচনকারী, ১২. প্রতিরোধকারী ইত্যাদি। রবের এই অর্থগুলোকে অস্বিকার করা আল্লাহ তা’আলার রবুবিয়্যাত বা প্রভুত্বকে অস্বিকার করার নামান্তর। -আদ দুরারুস সানিয়্যাহ (ইন্টারনেট)
নিম্নে আমরা আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. প্রদত্ত্ব রবের প্রত্যেকটি অর্থের ওপর সামান্য আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।
১. তিনি সমস্ত জাহানের ব্যবস্থাপক- নভোম-ল ও ভূম-লে যত প্রাণী বা বস্তু রয়েছে, তার সবকিছুর নিয়ন্ত্রক এবং ব্যবস্থাপক একমাত্র আল্লাহ তা’আলা। সমস্ত প্রাণীর চলা-ফেরা, সকল বস্তুর নড়া-চড়া এমনকি বৃক্ষের পাতা ঝরে পড়া পর্যন্ত তাঁর নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনার অধীনে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তিনি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত কাজের ব্যবস্থাপক’। -সূরা সাজদাহ-০৫
২. কর্তৃত্বশীল- দুনিয়া এবং আখিরাতের সকল কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহ তা’আলার। আজকে যারা দুনিয়ায় সামান্য ক্ষমতার অধিকারী হয়ে নিজেদের অবৈধ কর্তৃত্ব জাহির করছে, আঙ্গুলের হেলায় আর চোখের ইশারায় যারা অহরহ অন্যায় করে যাচ্ছে, তাদের স্মরণ রাখতে হবে- এই কর্তৃত্ব কিছুই নয়। দুটি চক্ষু বন্ধ হয়ে গেলে একটি আঙ্গুল হেলানোরও আর ক্ষমতা থাকবেনা। আল্লাহ তা’আলার কর্তৃত্ব সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘অগ্র-পশ্চাতের সকল কাজ (কর্তৃত্ব) আল্লাহর হাতেই’। -সূরা লুকমান-০৪
৩. সৃষ্টিকর্তা- মানুষসহ সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা’আলা। যেখানে অণু থেকে অণু পরিমাণ কোন বস্তুও আষ্কিারক ব্যতীত আবিষ্কার হতে পারে না, সেক্ষেত্রে এই বিশাল আসমান-যমীন, গ্রহ-নক্ষত্র, গাছ-পালা, তৃণ-লতা, পশু-পাখি ইত্যাদি কিভাবে একজন ¯্রষ্টা ব্যতীত এমনিতেই সৃষ্টি হতে পারে? মানুষের এই এই সুনিপুণ গঠন, সুন্দর অবয়ব একজন সুদক্ষ কারিগর ব্যতীত কিভাবে তৈরি সম্ভব? আর সেই সুদক্ষ কারিগরই হলেন মহান রাব্বুল আলামীন। যারা প্রাকৃতিকবাদী এবং ডারউইনের মতবাদে বিশ্বাসী, যারা মনে করে সবকিছুর সৃষ্টি কোন ¯্রষ্টা ব্যতীত এমনিতেই হয়ে গেছে, তারা আল্লাহ তা’আলার যেকোন সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করলেই তাতে ¯্রষ্টার পরিচয় লাভ করবে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘তিনিই আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনিই সব কিছুর ¯্রষ্টা। অতএব, তোমরা তাঁরই ইবাদত কর। তিনি প্রত্যেক বস্তুর কার্যনির্বাহী’। -সূরা আন’আম-১০২
৪. রিযিকদাতা- জলে-স্থলে যত প্রকার প্রাণী রয়েছে, সকল প্রাণীর রিযিকের যথাযথ ব্যবস্থা করেন মহান রাব্বুল আলামীন। আমরা কি কখনও চিন্তা করে দেখেছি, আমাদের গৃহপালিত যে পশুটি আছে, তার রিযিক আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতে সৃষ্টি করে রেখেছেন। আমরা শুধু তা সংগ্রহ করে তার সামনে উপস্থাপন করি। এতেই আমাদের কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয়! কিন্তু বন-জঙ্গলে, সমুদ্রে যে অসংখ্য প্রাণী বিচরণ করছে, তাদের রিযিক কে ব্যবস্থা করছে? নিশ্চয়ই রাব্বুল আলামীন। যেহেতু রিযিকের দায়িত্ব মহান রবের যিম্মায়, তাই রবের নাফরমানী করে রিযিকের জন্য এদিক সেদিক ছোটাছুটি করার কোন প্রয়োজন নেই। রিযিকের জন্য নিজের রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে অন্য রাষ্ট্রের গোলামী আর পদলেহনেরও কোন প্রয়োজন নেই। রিযিকের দায়িত্ব প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আর পৃথিবীতে কোন বিচরণশীল নেই, তবে সবার রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন, তিনি জানেন তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়। সবকিছুই এক সুবিন্যস্ত কিতাবে রয়েছে। -সূরা হুদ-০৬ অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে- ‘আল্লাহ তা’আলাই তো রিযিকদাতা, শক্তির আধার, পরাক্রান্ত’। -সূরা যারিয়াত-৮২
৫. বিধানদাতা- এ প্রসঙ্গে কুরআনে ইরশাদ হচ্ছেÑ ‘আল্লাহই একমাত্র আইনদাতা’। -সূরা আন’আম-৫৭ আমাদের বিধানদাতা যে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তা আমরা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারি। আমাদের চার পাশে যত নবআবিষ্কৃত বস্তু রয়েছে তা নিয়ে সামান্য গবেষণা করলেই আল্লাহ তা‘আলা আমাদের বিধানদাতা তা প্রতিয়মান হয়। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে মোবাইল। এই মোবাইলের একজন আবিষ্কারক রয়েছে। তা এমনিতেই অস্তিত্বে আসেনি। মোবাইল দ্বারা প্রকৃত উপকৃত হতে হলে তার আবিষ্কারকের বিধান এবং নীতি অনুযায়ী তা ব্যবহার করতে হবে। নিজের মনগড়া পদ্ধতি এবং বিধান অনুযায়ী মোবাইল ব্যবহার করলে তা থেকে কোনভাবেই উপকৃত হওয়া যাবেনা। তদ্রুপ মানুষেরও একই অবস্থা। মানুষ তার সৃষ্টিকর্তার বিধান অনুযায়ী না চললে কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না। পদে পদে সমস্যায় পতিত হবে। ব্যক্তি জীবনে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী চললে যেভাবে ব্যক্তি জীবন সুখী হবে, তদ্রুপ পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনেও আল্লাহর বিধান অনুযায়ী চললে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সুখী ও সমৃদ্ধ হবে।
৬. জীবনদাতা ও ৭. মৃত্যুদাতা- এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা সূরা মু’মিনের ৬৮ নং আয়াতে বলেন, তিনিই জীবিত করেন এবং মৃত্যু দেন।
৮. মর্যাদাদাতা ও ৯. লাঞ্ছনাকারী- পবিত্র কুরআনে সূরা আলে ইমরানের ২৬ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছেÑ বলুন ইয়া আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।
১০. দাতা ও ১১. সঙ্কোচনকারী- এ প্রসঙ্গে সহিহ বুখারী শরীফের ৮০৮ নং হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হে আল্লাহ! যাকে তুমি দান করো তাতে কেউ বাধা দানকারী নেই। আর যাকে তুমি সঙ্কোচন করো তাকে কেউ দানকারী নেই।
আল আলামীন
আলামুন আরবী একবচনবিশিষ্ট শব্দ; যার বহুবচন হল আলামীন। পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া যা কিছু সবকিছু আছে সব আলামুন এর অন্তর্ভূক্ত। যা দেখে আমরা কোন কিছু উপলব্ধি করতে পারি। পারতপক্ষে আমরা আল্লাহ পাকের সৃষ্টিজগৎ থেকে তার পরিচয়ের ব্যাপারে সম্যক ধারনা লাভ করতে পারি। তাই সূরা ফাতিহাতে এই কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। অন্য একটি মতামত হল এই যে, আলামুন দ্বারা জ্বিন, ইনসান ও ফিরিশতাগণকে বুঝানো হয়েছে।
৩য় মতটি হল এই যে, আলামুন দ্বারা সমগ্র মানবজাতিকে বুঝানোর মূল উদ্দেশ্য। কারণ মানব সভ্যতাকে জগতসমূহের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। কারণ মানবজাতির অস্তিত্বশীল বস্তুর সার নির্যাস। আল-মাওয়ারদী রহ. বলেন, দুনিয়া এবং দুনিয়ার ভিতর যা কিছু আছে সব কিছুই আলামুনের অন্তর্ভুক্ত।
সর্বশেষ বক্তব্য হল এই যে, পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টি যথাÑ মানব-দানব, ফেরেশতাকুল, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, জমিন এবং জমিনের মধ্যে যা আছে, যেমনÑ জীবজন্তু, জড়পদার্থ ও উদ্ভিদ সব কিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করছি, এর মধ্যেও আল্লাহ তা‘আলার কোটি কোটি সৃষ্টিবস্তু রয়েছে। এর কিছু আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, আর কিছু আমরা দেখিনা। এসবগুলোর প্রত্যেকটাই এক একটা আলম। Ñমা‘আরিফুল কুরআন
আলমের সংখ্যার ব্যাপারে মুফাসসিরীনে কিরাম বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। কোন কোন মুফাসসিরীনে কিরাম বলেছেন, আলম সর্বমোট সতের হাজার। কেউ বলেছেন আঠার হাজার। আবার কেউ বলেছেন আলম সর্বমোট আশি হাজার। কিন্তু বাস্তব কথা হলো আলমের প্রকৃত সংখ্যা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই জানেন। তাইতো তিনি বলেছেন, আপনার পালনকর্তার বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন। সূরা মুদ্দাসসিরÑ৩১
আয়াত নং ০২
“যিনি পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু।”
ইতোপূর্বে আমরা সুরায়ে ফাতেহার প্রথম আয়াত নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। এবারে দ্বিতীয় আয়াত নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। এখানে একটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন- সুরায়ে ফাতেহার আয়াত নির্ধারণ নিয়ে হানাফী এবং শাফেয়ী মাজহাবে মতপ্রার্থক্য আছে। হানাফী মাজহাব মতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সুরায়ে ফাতেহার অংশ নয়। এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আয়াত। আর শাফেয়ী মাজহাব মতে বিসমিল্লাহ সুরায়ে ফাতেহার অংশ এবং একটি আয়াত। তাই এই ইখতেলাফের কারণে আমাদের আজকের আলোচ্যআয়াত হানাফী মাজহাব মতে সুরায়ে ফাতেহার দ্বিতীয় আয়াত হবে। আর শাফেয়ী মাজহাব মতে এটি তৃতীয় আয়াত।
মূল আলোচনা
‘আর রাহমানির রাহিম’ অর্থাৎ যিনি পরম করুণাময় অসীম দয়ালু। পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, ‘তিনি সমস্ত জাহানের প্রতিপালক।’ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, আল্লাহ তা‘আলার প্রতিপালনের ধরন কেমন? এই আয়াতে ঁতঁর প্রতিপালনের ধরন সম্পর্কে আলোচনা করছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত জগতবাসীকে দয়ার মাধ্যমে লালন-পালন করেন। আল্লাহর যে শাস্তি ও ক্রোধ তা কেবল গুনাহগার বান্দাদেরকে সাজা দেয়ার জন্য। কোন রকম বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসাবশতঃ নয়। তাই আমরা যদি তওবা করি এবং অতীতের অপরাধের জন্য লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি, তাহলে তিনি আমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন এবং আমাদের দোষ ত্রুটি ঢেকে রাখবেন। এর থেকে আমাদের শিক্ষার বিষয় হলো, আমরা যারা সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বশীলের পদে আধিষ্ট আছি, অধ্বস্তনদের সাথে আমাদের সম্পর্ক হবে দয়া মায়া ও ভালোবাসার ভিত্তিতে। কাফের মুশরিকরা হরহামেশা আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতা করে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি কখনও তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দিচ্ছেন না। তাদেরকে নিয়মিত রিযিক দিচ্ছেন। তাই অধ্বস্তন কেউ যদি কখনও জ্ঞানের স্বল্পতা বা অন্য কোনো কারণে রূঢ় আচরণ করে ফেলে, তাহলে তার সাথে রাগারাগি না করে ধৈর্যধারণ করতে হবে।
‘রাহমান’ শব্দটি আল্লাহ তা‘আলার গুণবাচক নাম হওয়া সত্ত্বেও ‘আল্লাহ’ শব্দের ন্যায় কেবল তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট। তাই ‘রাহমান’ শব্দের অর্থ করা হয় কোনো মেহনত বা পরিশ্রমের বিনিময় ব্যতীত দয়া বর্ষণকারী। আর ‘রাহিম’ শব্দের অর্থ নেক কাজসমূহের উত্তম প্রতিদানকারী, প্রকৃত পরিশ্রমের প্রতিদানকারী।
কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন, ‘রাহমান’ দুনিয়াতে সাধারণভাবে সকলের জন্য দয়ার অর্থে ব্যবহার হয়েছে। আর ‘রাহিম’ পরকালে বিশেষভাবে সকল নেকবান্দাদের জন্য দয়া বর্ষণকারী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ ‘রাহমান’ শব্দটি সাধারণ অর্থে আর ‘রাহিম’ শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত।
আল্লাহ তা‘আলা অসমি দয়ার অধিকারী। কিন্তু সেই দয়া পেতে হলে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। এক. আল্লাহর ইতা‘আত (আনুগত্য) করতে হবে। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসুলের, যাতে তোমাদের ওপর রহমত (দয়া) করা হয়। সুরা আলে ইমরান -১৩২
দুই. তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, আমার আজাব তারই ওপর পরিব্যাপ্ত এবং আমার রহমত (দয়া) সকল বস্তুর ওপর পরিব্যাপ্ত। সুতরাং তা তাদের জন্য লিখে দেব যারা ভয় রাখে… সুরা আ‘রাফ -১৫৬
তিন. সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ করতে হবে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই ওপর আল্লাহ তা‘আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, সুকৌশলী।’ সুরা তাওবাহ-৭১
আল্লাহ তা‘আলার দয়া সম্পর্কে রাসুলে কারীম সা. ইরশাদ করেন, হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো এক যুদ্ধে আল্লাহর রাসুল সা.-এর নিকট কিছু যুদ্ধবন্দি উপস্থিত হলে সেখানে দেখা গেলো এক নারী তার সন্তানকে খুঁজছে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবন্দীদের মাঝে একটি শিশুকে পেয়ে তাকে নিয়ে জড়িয়ে ধরল এবং দুধ খাওয়ালো। আল্লাহর রাসুল সা. আমাদেরকে বললেন, তোমরা কি মনে কর, এই নারী তার সন্তানকে আগুনে ফেলে দিবে? আমরা বললাম, না আল্লাহর শপথ। (সে ফেলবে না) যতক্ষণ সে তাকে না ফেলে থাকতে পারে। অতঃপর আল্লাহর রাসুল সা. বললেন, এই নারী তার সন্তানের প্রতি যতটা না ¯েœহময়ী, দয়ালু- আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি তার চেয়েও বেশি দয়ালু। বুখারী, হাদিস নং ৫৯৯৯, মুসলিম, হাদিস নং- ২৭৫৪।
অন্য এক হাদিসে রাসুল সা. ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা দয়াকে ভাগ করে তাঁর নিকট নিরানব্বইটি ভাগ সঞ্চিত রেখেছেন এবং পৃথিবীতে একভাগ নাযিল করেছেন। আর এই একটি অংশের মধ্যেই সকল সৃষ্টি পরস্পরকে দয়া করে। এমনকি ঘোড়া তার সন্তান আহত হওয়ার ভয়ে তার থেকে ক্ষুর উঠিয়ে নেয়। বুখারী-৬০০০, মুসলিম- ২৭৫২
আয়াত নং ০৩
“প্রতিদান দিবসের মালিক”
সুরায়ে ফাতেহার তৃতীয় আয়াত হচ্ছে- ‘মা-লিকি ইয়াওমিদ্দীন’। অর্থাৎ ‘প্রতিদান দিবসের মালিক।’ মা-লিক শব্দটি এখানে মীম-এ আলিফ দিয়ে পড়া হয়েছে। কোনো কোনো কিরাআতে আলিফ ব্যতীতও পড়া হয়েছে। মুফাসসিরীনে কিরাম দুয়ের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন এভাবে, ‘মালিক’ (আলিফ ব্যতীত) বলতে বুঝায় যিনি তার প্রজা ও অনুগতদের সাধারণ কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত বিশেষ কাজ ও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। আর ‘মা-লিক’ (আলিফ সহকারে) যিনি সর্ববিষয়ে নিয়ন্ত্রণকারী। পূর্বের অর্থের চেয়ে এটি আরও ব্যাপক। তার কারণ হলো- মালিক এর চেয়ে মা-লিক এর মধ্যে একটি অক্ষর বেশি। আর আরবি ভাষার নিয়ম অনুযায়ী অক্ষরের আধিক্যের কারণে অর্থের মাঝে ব্যাপকতা আসে। ‘মা-লিক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে- মালিক, স্বত্বাধিকারী, একচ্ছত্র অধিপতি ইত্যাদি।
‘ইয়াওম’ সাধারণত সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত সময়কে বলে। শরীয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদিক হকে সূর্যাস্ত সময়কে ‘ইয়াওম’ বলে। তাছাড়া আরবি ভাষায় ‘ইয়াওম’ শব্দটি সময় বা কাল অর্থেও ব্যবহার হয়। আর এখানেও সে অর্থে ব্যবহার হয়েছে। দীন শব্দটি কুরআনুল কারিমে কয়েকটি অর্থে ব্যবহার হয়েছে। যেমন- ১. বাদশাহী বা রাজত্ব (সুরা ইউসুফ-৭৬), ২. পথ (সুরা কাফিরুন-৬), ৩. নির্দেশ বা হুকুম (সুরা আনফাল-৩৯), ৪. বিধান যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনিত করেছেন (সুরা শুরা-১৩), ৫. আনুগত্য (সুরা নাহল-৫২) ৬. প্রতিদান (সুরা যারিয়াত-৬)। সুরায়ে ফাতিহার এই আয়াতে দীন দ্বারা এই প্রতিদান-ই বুঝানো হয়েছে।
পারিভাষিকভাবে দীন বলা হয়, ঐ সমস্ত বিধানাবলীকে যা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে বান্দার ওপর অর্পিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, দীন বলা হয় মহান আল্লাহ প্রদত্ত এমন একটি জিবন বিধান, যা বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন সৃষ্টিকে তাদের প্রশংসনীয় পছন্দ ও শুভ বিবেচনার মাধ্যমে চিরকল্যাণের দিকে পরিচালিত করে।
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য রাখা দরকার যে, ইতোপূর্বে রাব্বুল আলামীন দ্বারা বুঝিয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া এবং আখিরাতের সব কিছুর মালিক। কিন্তু এখন আবার ‘মা-লিকি ইয়াওমিদ্দীন’ বলার কী প্রয়োজন ছিলো? প্রশ্নটা এভাবেও উত্থাপন করা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে প্রতিদান দিবসের মালিক তেমনি দুনিয়ার জগতেরও মালিক। তাহলে এখানে প্রতিদান দিবসকে কেন নির্দিষ্ট করা হলো?
উভয় প্রশ্নের উত্তরে মুফাসসিরীনে কিরাম বলেছেন, দুনিয়াতে মানুষ সাময়িকভাবে অনেক কিছুর মালিক হয়। যেমন- ক্ষমতা, টাকা-পয়সা, জায়গা-যমীন ইত্যাদি। কিন্তু তাদের এই মালিকানা একদম সীমিত। আজ আছে কাল নেই। অথচ আল্লাহ তা‘আলার মালিকানা চিরস্থায়ী। তাছাড়াও মানুষ দুনিয়াতে অনেক কিছুর দাবি করলেও তা এখানেই শেষ। বিচার দিবসে সামান্য কিছুরও মালিক হতে পারবে না। তাইতো আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন- ‘আজকের রাজত্ব কার? (তিনি নিজেই উত্তর দিবেন) এক প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহর’Ñসুরা মুমিন-১৬। ক্ষমতা, পদ বা দায়িত্ব, অর্থকড়ি, বংশ ইত্যাদির বড়াই সেদিন কোনো কাজে আসবে না।
সুরায়ে ফাতিহার উক্ত তিন আয়াত দ্বারা মুসলমানদের বিশেষ তিনটি আকিদাÑ তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত প্রমাণিত হয়। প্রথম আয়াত দ্বারা তাওহিদ তথা আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদ প্রমাণিত হয়। আর তা এভাবে যে, আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনÑ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি সমগ্র জাহানের প্রতিপালক। সমগ্র জাহানের প্রতিপালক তিনিই হতে পারেন যিনি তা সৃষ্টি করেছেন। এ কথা স্পষ্ট যে, সমস্ত জাহানের সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তাঁর ইশারায় আসমান-যমীন, গ্রহ-নক্ষত্র, চন্দ্র-সূর্য সব কিছু সৃষ্টি হয়েছে এবং তিনিই সব কিছুকে সুচারুভাবে পরিচালনা করেন। এই বিশ্বপরিম-ল পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত যদি অন্য কেউ থাকত তাহলে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যেত। এতেই আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদ প্রমাণিত হয়।
দ্বিতীয় আয়াতে রিসালাত প্রমাণিত হয় এভাবেÑ তিনি অসীম দয়ালু ও মেহেরবান। তাঁর দয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এই যে, তিনি মানুষ সৃষ্টি করে তাদেরকে ভালো এবং মন্দের পথ পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। যদি তিনি মানুষ সৃষ্টি করেই ক্ষ্যান্ত থাকতেন, তাদেরকে কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ তা পরিচয় করিয়ে না দিতেন, কোনটি সফলতার পথ আর কোনটি ধ্বংসের পথ তা জানিয়ে না দিতেন, তাহলে মানুষের প্রতি তাঁর দয়ার পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ হতো না। তাই তিনি অনুগ্রহ করে ভালো-মন্দের পথ চিনিয়ে দিয়েছেন। আর একাজটি করেছেন তিনি আম্বিয়ায়ে কিরাম আ. প্রেরণের দ্বারা। অর্থাৎ নবীগণ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে মানুষকে ভালো এবং মন্দের পথ সম্পর্কে অবহিত করেছেন, যাতে মানুষ মন্দ পথ ছেড়ে ভালোর পথে পরিচালিত হয়। তাই মানুষদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য নবী-রাসুলদের প্রেরণ আল্লাহ তা‘আলার অনেক বড় অনুগ্রহ। আর নবী-রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন-ই হলো রিসালাত সংক্রান্ত আকিদা।
তৃতীয় আয়াত দ্বারা আখিরাত প্রমাণিত হওয়া স্পষ্ট। প্রতিদান দিবস মানেই হলো আখিরাত। এই আয়াত থেকে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় একটি বিষয় হলো, এই আয়াতের তাৎপর্য যদি সর্বদা আমাদের মানস্পটে থাকে, তাহলে আমরা প্রত্যেকেই পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত আদর্শ জীবন গঠন করতে পারবো। কারণ যখনই আমি কোনো অন্যায় কাজ করতে যাবো তখন যদি এই কথা স্মরণ আসে যে, এর জন্য আমাকে জবাবদিহী করতে হবে, এর প্রতিদান আমাকে কাল কিয়ামতে প্রদান করা হবে, তখন হয়তো এই ভয়ে হলেও আমি সেই কাজ থেকে বিরত থাকবো। অনুরূপভাবে নেক কাজ করতে গেলেও এ কথা স্মরণ আসলে সে কাজের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। এভাবে ন্যায় ও নেকের কাজে আগ্রহ বৃদ্ধি পেলে এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে পারলে আমরা আদর্শ মানুষে পরিণত হবো। আমরা আদর্শ মানুষ হলে সমাজ- ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রও আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
আয়াত নং ০৪
“আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।”
সুরা ফাতিহার চতুর্থ আয়াতটি হলÑ “ইয়্যাকা না‘বুদু ওয়া ইয়্যাকানাস্তাঈন”। অর্থাৎ আমরা শুধু তোমারই উপাসনা করি এবং একমাত্র তোমার কাছ থেকে সাহায্য চাই।
পূর্বের আয়াতগুলোয় আমরা আল্লাহর কিছু গুণ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আমরা জেনেছি যে তিনি “রহমান”, “রাহিম”, “রাব্বুল আলামিন” এবং বিচার দিনের মালিক। এ ছাড়াও এ অন্তহীন বিশ্বজগত এবং আমাদের প্রতি তাঁর প্রশংসা জ্ঞাপন করে বলেছি “আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন”।
তাই আমাদের কর্তব্য হল তাঁর দরবারে গিয়ে নিজের অক্ষমতা ও দুর্বলতা তুলে ধরে বলা যেÑ আমরা একমাত্র তোমারই বান্দা এবং একমাত্র তোমার নির্দেশ ছাড়া অন্য কারো কাছে বা নির্দেশের সামনে মাথা নত করব না। আমরা দুনিয়ার ধন দৌলতের পূজারী নই এবং শোষক ও সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিরও গোলাম নই।
সুরায়ে ফাতিহার এই আয়াতের দুটি অংশ। প্রথম অংশে আমরা স্বীকৃতি দিচ্ছিÑ আমরা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার-ই ইবাদত করি। অন্য কারো ইবাদত করি না। ইবাদত মানে হুকুম পালন করা, নির্দেশ মানা, আনুগত্য করা। পারিভাষিকভাবেÑ দৈনন্দিন জীবনের সব কাজ-কর্মে আল্লাহ তা‘আলার বিধি-বিধান মেনে চলাকে ইবাদত বলা হয়। অন্যভাবে বলা যায়Ñ কোনো সত্তাকে গায়েবীভাবে ভালমন্দের মালিক এবং সকল প্রয়োজন পূর্ণ করার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করে তাঁর সামনে নিজের নিতান্ত হীনতা ও মুখাপেক্ষিতা প্রকাশের জন্য, তাকে রাজি-খুশি করার জন্য এবং তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্য যেসব উপাসনামূলক কাজ করা হয় তাকেই ইবাদত বলে।
আমরা আল্লাহ তা‘আলার আদেশ পালন করি- কারণ, আমরা তাঁর বান্দা। বান্দা হিসেবে আমাদেরকে বন্দেগী করতেই হবে। আমরা যেহেতু সার্বক্ষণিক আল্লাহ তা‘আলার বান্দা তাই সার্বক্ষণিক তাঁর ইবাদত করতে হবে। সার্বক্ষণিক ইবাদতের অর্থ হলÑ আমাদের দৈনন্দিন সকল কাজ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ অনুযায়ী হতে হবে। আমাদের ব্যক্তিগত কাজ, পারিবারিক কাজ, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ইত্যাদি সকল কাজ তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী করতে হবে।
আয়াতের দ্বিতীয় অংশে আমরা স্বীকার করছিÑ আমরা কেবল তোমার কাছেই সাহায্য চাই। আল্লাহ তা‘আলার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করাও একটি অন্যতম ইবাদত। এমনকি আমরা ইবাদতও আল্লাহর সাহায্যে করি। আল্লাহ আমাদের সাহায্য না করলে হয়তো আমরা অন্যদের গোলাম ও দাসে পরিণত হতাম। যে যত বেশি আল্লাহর ইবাদতকারী, সে তত বেশি তাঁর সাহায্যপ্রার্থী। তাই দেখা গেছে, দুনিয়ায় প্রেরিত নবী-রাসুলরা আল্লাহর কাছে বেশি বেশি সাহায্য চাইতেন। বিখ্যাত অলি-আউলিয়াদের অভ্যাসও এমন ছিল।
এখানে কোন বিষয়ে আমরা আল্লাহর সাহায্য চাই তা উল্লেখ করা হয়নি। এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছেÑ দুনিয়া-আখিরাতের সকল বিষয়েই আমরা তাঁর সাহায্য চাই। আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত যেভাবে আমাদের আখিরাতের মুক্তি সম্ভব নয়; তদ্রুপ দুনিয়াবী সকল কাজও তাঁর সাহায্য ব্যতীত সম্পাদন করা আমাদের জন্য অসম্ভব। ব্যক্তিগত ছোটখাট কাজ থেকে শুরু করে পরিবার পরিচালনা, সমাজ পরিচালনা, সংগঠন পরিচালনা এবং রাষ্ট্র পরিচালনাসহ সকল কাজে আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কাউকে প্রকৃত সাহায্যকারী মনে করলে তা শিরক হবে। কোন রাষ্ট্র, পীর, মাজার ইত্যাদিকে প্রকৃত সাহায্যকারী মনে করা, অমুক রাষ্ট্র সাহায্য না করলে আমাদের রাষ্ট্র চলবে না, অমুক পীর সাহায্য না করলে আমার মুক্তি হবে নাÑ ইত্যাদি বিশ্বাস রাখা আল্লাহ তা‘আলার সাথে চরম পর্যায়ের শিরক হবে।
দুনিয়ার মানুষের কাছে চাইলে বিরক্তিবোধ করে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা ভিন্ন। তাঁর কাছে না চাইলে তিনি রাগ করেন। তাইতো তিরমিজী শরিফের হাদিসে এসেছেÑ ‘যে আল্লাহর কাছে কিছু চায় না আল্লাহ তার ওপর রাগ করেন।
সুরা ফাতিহার ৪র্থ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলÑ নামাজের মধ্যে আমরা যেভাবে সুরা ফাতিহা পাঠ করে আল্লাহর ইবাদতের এবং তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনার স্বীকৃতি দিয়ে থাকি, নামাজের বাইরেও সেই স্বীকৃতির কথা স্মরণ রাখতে হবে।
এ আয়াত থেকে আরেকটি শিক্ষণীয় বিষয় হল, প্রত্যেক নামাজে যদি আমরা গভীর উপলদ্ধির সাথে বলি যে, আমরা কেবল তোমারই বান্দা; তাহলে আমাদের মধ্য থেকে গর্ব, অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্য দূর হয়ে যাবে।
আয়াত নং ০৫
“আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা কর”
সুরা ফাতিহার পঞ্চম আয়াতটি হলÑ “ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম”। অর্থাৎ- তুমি আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা কর। হিদায়াত অর্থ পথ প্রদর্শন করা। হিদায়াতের কয়েকটি স্তর রয়েছে। কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা এই স্তরসমূহ প্রমাণিত। হিদায়াথের প্রথম স্তর সাধারণ ও ব্যাপক। এতে সমগ্র সৃষ্টি অন্তর্ভুক্ত। জড় প্রদার্থ, উদ্ভিদ এবং প্রাণিজগতও এর অন্তর্ভুক্ত।এ প্রসঙ্গে অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘তিনি প্রত্যেক বস্তুর অস্তিত্ব দান করেছেন এবং সে অনুপাতে তাকে হিদায়াত দান করেছেন।’ অর্থাৎ তিনি সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য বিশেষ অভ্যাস ও বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব নির্ধারণ করেছেন। আর সে অভ্যাস ও দায়িত্বানুযায়ী হিদায়াত দান করেছেন। এই হিদায়াতের কারণে সৃষ্টি জগতের প্রতিটি বস্তুই নিপুণভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে চলেছে।
হিদায়াতের দ্বিতীয় স্তর প্রথমটির তুলনায় অনেকটা সংকীর্ণ। এই হিদায়াত দ্বারা উদ্দেশ্য- যারা বিবেকবান ও বুদ্ধিসম্পন্ন। অর্থাৎ মানুষ এবং জিন জাতি। এই হিদায়াত নবী রাসুল এবং আসমানী কিতাবের মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের নিকট পৌঁছেছে। কেউ তা গ্রহণ করে মুমিন হয়েছে আবার কেউ একে প্রত্যাখ্যান করে কাফের বেঈমানে পরিণত হয়েছে।
হিদায়াতের তৃতীয় স্তর আরো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তা শুধু মুমিন ও মুত্তাকিদের জন্য। এই হিদায়াত আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে কোন প্রকার মাধ্যম ব্যতীতই মানুষকে প্রদান করা হয়। এরই নাম তাওফিক। অর্থাৎ এমন অবস্থা, পরিবেশ ও মনোভাব সৃষ্টি করে দেওয়া যে, এর ফলে কুরআনের হিদায়াত গ্রহণ করা এবং এর ওপর আমল করা সহজসাধ্য হয় এবং এর বিরুদ্ধাচারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। -মাআরিফুল কুরআন, মুফতি শফি রহ. (সংক্ষেপিত)
সিরাত মানে পথ। আর মুসতাকিম মানে সঠিক। সঠিক পথের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন- যে পথের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য থাকে তাকে সঠিক পথ বলে। এক. সোজা হওয়া। আঁকাবাঁকা না হওয়া। দুই. প্রশস্ত হওয়া। তিন. এই পথে গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হওয়া। চার. গন্তব্য নিকটবর্তী হওয়া এবং পাঁচ. গন্তব্যে পৌঁছতে এ পথ ব্যতীত বিকল্প পথ না থাকা। সিরাতে মুসতাকিম দ্বারা উদ্দেশ্য দীন ইসলাম। আর এর মাঝে এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। -মাআরিফুল কুরআন, কান্ধলভী রহ.।
সিরাতে মুসতাকিম দ্বারা উদ্দেশ্য দীন ইসলাম। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. প্রমুখ সাহাবী থেকে এটি বর্ণিত হয়েছে। হজরত মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া রহ. বলেন- এর দ্বারা উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘আলার ঐ দীন যা ব্যতীত অন্য কিছু তাঁর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।
সরল পথ মানে সব কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বন এবং যেকোন ধরনের বাড়াবাড়ি বর্জন। অনেকে মূলনীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির স্বীকার হয় এবং অনেকে কর্মক্ষেত্রে ও নৈতিক ক্ষেত্রে ভুল পথে চলে যায়। অনেকে আবার সব কাজের জন্য আল্লাহকে দায়ী করে; যেন পরিণতির ব্যাপারে মানুষের কোন হাত নেই। কেউ আবার সব কাজে নিজের ক্ষমতাকে চূড়ান্ত মনে করে যেন সৃষ্টি জগতের কাজ-কর্মে আল্লাহর কোন হাত নেই। অনেক কাফের আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ নবী-রাসুলদেরকে সাধারণ মানুষ এমনকি পাগল বলেও আখ্যায়িত করেছিল। অনেক বিশ্বাসী ব্যক্তি আবার হজরত ঈসা আ.-এর মতো নবীকে খোদার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের চিন্তা ও আচরণের অর্থ হল রাসুল এবং তাঁর সাহাবায়ে কিরামের নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যূত হওয়া। পবিত্র কুরআন আমাদেরকে আর্থ-সামাজিক কাজ-কর্ম ও ইবাদতের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে। যেমন সুরা আ‘রাফের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘তোমরা খাও এবং পান করো। তবে অপব্যয় করো না।’ সুরা আসরা বা বনী ইসরাইলের ১১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘নামাজে স্বর উঁচুও করো না আবার অতিশয় ক্ষীণও করো না। বরং এ দুইয়ের মধ্যপন্থা অবলম্বন কর। একইভাবে সুরা ফুরকানের ৬৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘মুমিন ব্যক্তিরা যখন দান করে তখন তারা অপব্যয় করে না আবার কার্পণ্যও করে না। বরং তারা এ দুইয়ের মধ্যপন্থা অবলম্বন করে।’ ইসলাম ধর্মে পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের ওপর অত্যন্ত জোর দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ‘পিতা-মাতার প্রতি উত্তম আচরণ করো।’ আবার সেখানে এও বলা হয়েছে যে, ‘তারা যদি তোমাকে মিথ্যা পথে পরিচালিত করতে চায় তবে তাদের আনুগত্য করবে না।’ যারা কেবল সমাজ থেকে বেরিয়ে একাকি এবাদত-বন্দেগীতে মশগুল হয় কিংবা শুধু মানবসেবাকে ইবাদত বলে, তাদের ধারনার জবাবে পবিত্র কুরআন নামাজ ও জাকাতকে পাশাপাশি বর্ণনা দিয়ে বলেছে, ‘তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং জাকাত আদায় কর।’ সর্বোপরী সিরাতে মুসতাকিম দ্বারা উদ্দেশ্য এমন মধ্যম পথ- যা সীমা অতিক্রম এবং মর্জি মতো কাটছাট করে নেওয়া থেকে মুক্ত।
সারকথা, মানুষের জীবন যাপনের জন্য বিভিন্ন পথ রয়েছে। ব্যক্তি তার নিজস্ব চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী পথ বেছে নিতে পারে। সমাজ ও জনগণের চলার পথ, পূর্বপুরুষদের অনুসৃত পথ, জনগণের জন্য অত্যাচারী শাসক ও তাগুতী শক্তির পক্ষ থেকে নির্ধারিত পথ। একটি পথ হল দুনিয়ার যাবতীয় রং, রূপ ও সৌন্দর্য উপভোগ করা। আবার অন্য একটি পথ হল সমাজ জীবন থেকে বেরিয়ে একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা বেছে নেয়া। এত সব পথের মধ্যে সঠিক পথ বেছে নেয়ার জন্য মানুষের কি পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন নেই? আল্লাহ পাক মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য নবী রাসুল ও আসমানী কিতাব পাঠিয়েছেন। তাই মানুষ যদি পবিত্র কুরআন, রাসুল সা.-এর অনুসরণ করে তাহলে সঠিক পথের সন্ধান পাবে। তাইতো আমরা প্রত্যেক নামাজে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যাতে তিনি আমাদেরকে সরল, সঠিক পথে পরিচালিত করেন। যে পথে কোন ক্ষতি ও বিভ্রান্তি নেই, তিনি যাতে ঐ পথে আমাদেরকে পরিচালিত করেন।
আয়াত নং ০৬
“যারা আপনার অনুগ্রহ লাভ করেছে তাঁদের পথ”
“সিরাতাল্লাযিনা আন‘আমতা আলাইহিম” অর্থাৎ তাঁদের পথ যারা আপনার নি‘আমত বা অনুগ্রহ লাভ করেছে। এ আয়াতটি পূর্বের আয়াত “ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম”-এর ব্যাখ্যা। যারা আপনার অনুগ্রহ বা দয়া পেয়েছে তাঁদের পথই সোজা-সরল রাস্তা। এতে করে এ কথাটিও প্রমাণিত হয়েছে যে, ঐ সমস্ত প্রিয়জন লোকের পথ যাদের মুস্তাকিম হওয়ার বিষয়টি সুস্বীকৃত। এর অর্থ দাঁড়াবে এরকম- হে আল্লাহ্! আমাদেরকে ঐ সমস্ত লোকের পথানুগামী কর, যাঁদেরকে তুমি করুণা সিক্ত করেছ। ঐ অনুগ্রহপ্রাপ্ত লোকেরাই ঈমান ও আনুগত্যের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত। আর করুণাসিক্ত বা অনুগ্রহপ্রাপ্ত প্রিয়ভাজন কারা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই কুরআনের অন্যত্র জানিয়ে দিয়েছেন- “নি‘আমতপ্রাপ্তরা হলেন নবীগণ, সিদ্দিকগণ, শহিদগণ ও সালেহিনগণ।” আল্লাহ’র দরবারে মকবুল উপরোক্ত লোকদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর নবীগণের। অতঃপর নবীগণের উম্মতের মধ্যে যারা সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী, তাঁরা হলেন ‘সিদ্দিক’ যাদের মধ্যে রূহানী কামালিয়াত ও পরিপূর্ণতা রয়েছে। আর যারা দীনের প্রয়োজনে স্বীয় জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন, তাঁদেরকে বলা হয় শহিদ। আর সালেহিন হলো সৎকর্ম পরায়ণশীল তাঁরা আউলিয়ায়ে কিরামের অন্তর্ভুক্ত।
অতএব, বুজুর্গানে দীন বা আউলিয়ায়ে কিরাম যে সকল আমল করেছেন বা যে পথে চলেছেন তা-ই ‘সিরাতুল মুস্তাকিম।’ এছাড়া এটাও প্রমাণিত হল যে- হজরতআবু বকর সিদ্দীক রা.-এর খেলাফত হক বা সঠিক। কেননা সিদ্দীকিনদের মধ্যে সর্বোচ্চ হলেন আবু বকর সিদ্দীক রা.।
ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে আনআ’মা এসেছে “নুউ’মা” থেকে, যার অর্থ ন¤্র, শান্ত, শিথিল ইত্যাদি। যেমন গরু, ভেড়াকে আনআ’ম বলা হয়, কারণ তারা সবসময়ই শান্ত, ধিরস্থির থাকে। আল্লাহ এখানে আনআ’মা শব্দটি ব্যবহার করে আমাদেরকে শেখাচ্ছেন যে, যারা সিরাতুল মুস্তাকিমে চলে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে, তাদের ওপরে আল্লাহ শান্তি বর্ষণ করেছেন। তারা এখন শান্ত, শিথিল।
বান্দার উপকারার্থে আল্লাহ তা‘আলা যাই প্রদান করেন তাই নি‘আমত। এই নি‘আমত তিন প্রকার। এক. যা সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত। এতে অন্য কারো কোন হস্তক্ষেপ নেই। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আলো, বাতাস দান করছেন ইত্যাদি। দুই. বাহ্যিকভাবে আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারো থেকে প্রাপ্ত। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তাও আল্লাহ তা‘আলা থেকে প্রাপ্ত। কেননা ঐ নি‘আমতটাও আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেছেন। নি‘আমতদাতাকেও তিনি সৃষ্টি করেছেন, ঐ ব্যক্তিকে নি‘আমত দেওয়ার ইচ্ছা তার অন্তরে আল্লাহ তা‘আলাই দিয়েছেন। তিন. আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যের ফলে তিনি আমাদেরকে যে নি‘আমত দান করেছেন। এটিও মূলতঃ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকেই। কারণ, তিনি যদি আমাদেরকে ইবাদতের শক্তি না দিতেন, সহযোগিতা না করতেন তাহলে আমরা ইবাদত করতে পারতাম না। সুতরাং এটাই স্পষ্ট কথা- যত ধরণের নি‘আমতই আমরা ভোগ করি না কেন, সবই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আসে।
সরল পথ নির্ধারণের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক স্বীয় বান্দাদের তালিকা প্রদান দ্বারা এই বিষয়ে ইঙ্গিত করা হচ্ছে যে- শুধুমাত্র কিতাবের পাঠই পূর্ণ তালিম ও তারবিয়াতের জন্য যথেষ্ট নয়; বরং কোন বিজ্ঞ লোকের নিকট এর শিক্ষা লাভ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বুঝা গেল- মানুষের প্রকৃত মুক্তি এবং কল্যাণপ্রাপ্তির জন্য দুটি উপাদানের প্রয়োজন। প্রথমতঃ আল্লাহর কিতাব- যাতে মানবজীবনের সকল দিকের পথনির্দেশ রয়েছে। অপরটি হচ্ছে আল্লাহর প্রিয় বান্দা বা আল্লাহওয়ালাগণ। তাঁদের কাছ থেকে ফায়দা হাসিল করার মাপকাঠি হচ্ছে এই যে- আল্লাহর কিতাবের নিরিখে তাঁদেরকে পরীক্ষা করতে হবে। এ পরীক্ষায় যারা টিকবে না তারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র নয়। আর কুরআনের নিরিখে যারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র স্থির হয় তাঁদের নিকট আল্লাহর কিতাবের শিক্ষা লাভ করে সে অনুযায়ী আমল করতে হবে।
ইমাম রাযি রহ. স্বীয় তাফসিরে কাবির-এ “আন‘আমতা আলাইহিম”-এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন- ‘আল্লাহ তা‘আলা শুধু “ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম” বলে ক্ষ্যান্ত হননি; বরং সাথে সাথে “সিরাতাল্লাযিনা আন‘আমতা আলাইহিম”ও বলেছেন। এর দ্বারা এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে- হিদায়াতের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে হলে এমন একজন শাইখের অনুসরণ করতে হবে যিনি তাকে হিদায়াতের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পথপ্রদর্শন করবেন। তাকে পথভ্রষ্ট এবং ভুলপথে পরিচালিত হওয়া থেকে ফিরিয়ে রাখবেন। শাইখ বা মুর্শিদের অনুসরণ করাটা এজন্যই জরুরি যে, অধিকাংশ মানুষের জ্ঞান স্বল্প। এই জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে তারা ধর্মীয় বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারে না। সত্য-মিথ্যার মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। তাই কুরআন-হাদিসের জ্ঞানে পূর্ণাঙ্গ এমন একজন ব্যক্তির অনুসরণ জরুরি যিনি এই স্বল্প জ্ঞানের মানুষটিকে পথপ্রদর্শন করবে। স্বল্প জ্ঞানের লোকটি তাঁর সংস্পর্শে থেকে ফয়েজ ও কামালাত অর্জন করবে। ক্রমান্বয়ে সে সৌভাগ্যের সোপান এবং পূর্ণাঙ্গতার সিঁড়ি অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। পীর বা মুর্শিদের প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে এটি একটি অকাট্য দলিল।
আয়াত নং ০৭
‘তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত এবং যারা পথভ্রষ্ট’
সুরা ফাতিহার সপ্তম আয়াতটি পূর্ববর্তী আয়াত ‘আন’আমতা আলাইহিম’-এর ব্যাখ্যাবোধক। অর্থাৎ যাঁদেরকে আল্লাহ তা’আলা তাঁর করুণা দানে ধন্য করেছেন, তারাই আল্লাহ’র গজব ও পথভ্রষ্টতা থেকে মুক্ত বা সুরক্ষিত।
এই দুটি আয়াতে মানুষের তিনটি দলের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। জীবন চলার পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষ ৩টি দলে বিভক্ত। এক দল আল্লাহর পথ বেছে নেয় এবং আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান অনুযায়ী নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পরিচালনা করে। এ দল সবসময় আল্লাহর রহমত, অনুগ্রহ ও দয়া লাভ করে। প্রথম দলের বিপরীতে আরেকটি দল রয়েছে যারা সত্য চেনার পরও আল্লাহকে ছেড়ে গায়রুল্লাহকে বেছে নিয়েছে এবং নিজের কামনা-বাসনা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজন ও সমাজের ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর প্রাধান্য দেয়। এ দলের লোকদের মধ্যে তাদের কৃতকর্মের প্রভাব ধীরে ধীরে গেঁড়ে বসে এবং তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়। তারা আল্লাহর সান্নিধ্য এবং দয়া লাভের পরিবর্তে ধ্বংসের অতল গহ্বরে পতিত হয়, আর আল্লাহর গজবের মধ্যে পড়ে। এই আয়াতে এ দলকে “মাগযুবি আলাইহিম” বা ক্রোধনিপতিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তৃতীয় আরেকটি দল রয়েছে যাদের কোন সুনির্দিষ্ট পথ নেই এবং কোন্ পথে চলবে তা ঠিক করতে পারেনি। তারা দিগভ্রান্ত এবং বিভ্রান্ত। এ আয়াতে তাদেরকে “যাল্লিন” বা পথভ্রষ্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তারা প্রতিদিন একেক পথ বেছে নেয় কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না।
প্রতিশোধ স্পৃহার উল্লাস ও উদ্দীপনার নাম গজব। কিন্তু এর সম্পর্ক যখন আল্লাহ’র সঙ্গে করা হয়, তখন তার মর্ম হবে গজবের পরিণাম বা পরিসমাপ্তি। ‘যালালাহ’ শব্দটি হেদায়েতের পথের বিপরীত অর্থবোধক শব্দ। অর্থাৎ যে পথ আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছায়, ঐ পথের প্রতি বিমুখতাই ‘যালালাহ’ বা পথভ্রষ্টতা।
এখন একটি প্রশ্ন জাগে- ক্রোধের শিকার ও পথভ্রষ্ট কারা? এর উত্তরে হজরত আদি বিন হাতেম রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যাদের প্রতি গজব অবতীর্ণ হয়েছে তারা ‘ইয়াহুদি’, আর যারা পথভ্রষ্ট তারা ‘খ্রিস্টান’। -তিরমিজী
উক্ত হাদিস দ্বারা এটা উদ্দেশ্য নয় যে- ‘মাগযুব আলাইহিম’ বলতে শুধু ইয়াহুদিরাই উদ্দেশ্য আর ‘যাল্লিন’ দ্বারা শুধু খ্রিস্টানরাই উদ্দেশ্য। বরং প্রত্যেক প্রকারের পথভ্রষ্ট, কাফের, ফাসেক, অবাধ্য, বেদাতী তাদের স্তর হিসেবে এর অন্তর্ভুক্ত।
তাফসিরে মাযহারী’র লেখক মাওলানা সানাউল্লাহ পানিপথী রহ. বলেন, ‘গাইরিল মাগযুবি আলাইহিম ওয়ালায যাল্লিন’ অর্থাৎ অভিশপ্তÍ ও পথভ্রষ্ট- এ শব্দ দু’টিতে সাধারণভাবে সকল সত্য প্রত্যাখ্যানকারী, অবাধ্য এবং বেদাতী সম্প্রদায় শামিল রয়েছে। তাফসিরে মা‘আরিফুল কুরআনে এই আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে- ‘মাগযুব আলাইহিম বলতে ঐ সকল লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে- যারা ধর্মের হুকুম-আহকামকে বুঝে-জানে, তবে স্বীয় অহমিকা ও ব্যক্তিগত স্বার্থের বশবর্তী হয়ে বিরুদ্ধাচরণ করে। অন্য শব্দে বলা যায়- যারা আল্লাহ তা‘আলার আদেশ মান্য করতে গাফলতি করেছে। যেমন, সাধারণভাবে ইয়াহুদিদের নিয়ম ছিল, সামান্য স্বার্থের কারণে দীনের নিয়ম-নীতি বিসর্জন দিয়ে তারা নবী রাসুলগণের অবমাননা- এমনকি হত্যা পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করত না।
আর যাল্লিন তাদেরকে বলা হয়- যারা না বুঝে অজ্ঞতার দরুন ধর্মীয় ব্যাপারে ভুল পথের অনুসারী হয়েছে এবং ধর্মের সীমালঙ্ঘন করে অতিরঞ্জনের পথে অগ্রসর হয়েছে। যথা- নাসারাগণ। তারা নবীর শিক্ষাকে অগ্রাধিকার প্রদানের নামে বাড়াবাড়ি করে নবীদেরকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে।
সুতরাং আয়াতের সারমর্ম হচ্ছে- আমরা সে পথ চাই না, যা নফসানী উদ্দেশ্যের অনুগত হয় এবং মন্দকাজে উদ্বুদ্ধ করে ধর্মের মধ্যে সীমালঙ্ঘনের প্রতি প্ররোচিত করে। সে পথও চাই না, যে পথ অজ্ঞতা ও মুর্খতার দরুন ধর্মের সীমারেখা অতিক্রম করে। বরং এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সোজা-সরল পথ চাই। যার মধ্যে না অতিরঞ্জন আছে, আর না কম-কছুরী আছে এবং যা নফসানী প্রভাব ও সংশয়ের উর্ধ্বে।’
সুরা ফাতিহার পর নামজে ও নামাজের বাইরে আমিন বলা সুন্নাত। আমাদের হানাফি মাজহাবে নামাজে নীরবে আমিন বলতে হয়। আমিন- এর অর্থ হল ‘এরূপ করো’ অথবা ‘কবুল করো’। ‘আমিন’ এটা কুরআনের শব্দ নয়।
সুরা ফাতিহার আয়াত সাতটির তাফসির শেষ হয়েছে। এখন সমগ্র সুরার সারমর্ম হচ্ছে এ দোয়া- হে আল্লাহ্! আমাদিগকে সরল পথ দান করুন। কেননা সরল পথের সন্ধান লাভ করাই সবচেয়ে বড় জ্ঞান ও সর্বাপেক্ষা বড় সফলতা। বস্তুতঃ সরল পথের সন্ধানে ব্যর্থ হয়েই দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি ধ্বংস হয়েছে। অন্যথায় অ-মুসলমানদের মধ্যেও সৃষ্টিকর্তার পরিচয় লাভ করা এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথ অনুসরণ করার আগ্রহ-আকুতির অভাব নেই। এ জন্যই কুরআন শরিফে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় পদ্ধতিতেই সিরাতে মুস্তাকিমের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। আর সুরায়ে ফাতিহাতে নবী-অলী’র পথকেই ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ বলা হয়েছে। সুরা ফতিহাকে ‘উম্মুল কুরআন’ বলা হয়। যে ব্যক্তি সুরা ফাতিহা বুঝতে পারল সে গোটা কোরআন শরিফ ও ইসলামকে বুঝতে পারল।
(সমাপ্ত)