সূরা ফাতেহা’র ধারাবাহিক দারস (৫)
-মুফতি আবদুর রহমান গিলমান
“যিনি পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু।” (সূরা ফাতিহা : ০২)
ইতোপূর্বে আমরা সুরায়ে ফাতেহার প্রথম আয়াত নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। এবারে দ্বিতীয় আয়াত নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। এখানে একটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন- সুরায়ে ফাতেহার আয়াত নির্ধারণ নিয়ে হানাফী এবং শাফেয়ী মাজহাবে মতপ্রার্থক্য আছে। হানাফী মাজহাব মতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সুরায়ে ফাতেহার অংশ নয়। এটি একটি স্বয়ংসম্পন্ন আয়াত। আর শাফেয়ী মাজহাব মতে বিসমিল্লাহ সুরায়ে ফাতেহার অংশ এবং একটি আয়াত। তাই এই ইখতেলাফের কারণে আমাদের আজকের আলোচ্যআয়াত হানাফী মাজহাব মতে সুরায়ে ফাতেহার দ্বিতীয় আয়াত হবে। আর শাফেয়ী মাজহাব মতে এটি তৃতীয় আয়াত।
মূল আলোচনা
‘আর রাহমানির রাহিম’ অর্থাৎ যিনি পরম করুণাময় অসীম দয়ালু। পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, ‘তিনি সমস্ত জাহানের প্রতিপালক।’ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, আল্লাহ তা‘আলার প্রতিপালনের ধরন কেমন? এই আয়াতে তাঁর প্রতিপালনের ধরন সম্পর্কে আলোচনা করছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত জগতবাসীকে দয়ার মাধ্যমে লালন-পালন করেন। আল্লাহর যে শাস্তি ও ক্রোধ তা কেবল গুনাহগার বান্দাদেরকে সাজা দেয়ার জন্য। কোন রকম বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসাবশতঃ নয়। তাই আমরা যদি তওবা করি এবং অতীতের অপরাধের জন্য লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি, তাহলে তিনি আমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন এবং আমাদের দোষ ত্রæটি ঢেকে রাখবেন। এর থেকে আমাদের শিক্ষার বিষয় হলো, আমরা যারা সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বশীলের পদে আধিষ্ট আছি, অধ্বস্তনদের সাথে আমাদের সম্পর্ক হবে দয়া মায়া ও ভালোবাসার ভিত্তিতে। কাফের মুশরিকরা হরহামেশা আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতা করে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি কখনও তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দিচ্ছেন না। তাদেরকে নিয়মিত রিযিক দিচ্ছেন। তাই অধ্বস্তন কেউ যদি কখনও জ্ঞানের ¯^ল্পতা বা অন্য কোনো কারণে রূঢ় আচরণ করে ফেলে, তাহলে তার সাথে রাগারাগি না করে ধৈর্যধারণ করতে হবে।
‘রাহমান’ শব্দটি আল্লাহ তা‘আলার গুণবাচক নাম হওয়া সত্তে¡ও ‘আল্লাহ’ শব্দের ন্যায় কেবল তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট। তাই ‘রাহমান’ শব্দের অর্থ করা হয় কোনো মেহনত বা পরিশ্রমের বিনিময় ব্যতীত দয়া বর্ষণকারী। আর ‘রাহিম’ শব্দের অর্থ নেক কাজসমূহের উত্তম প্রতিদানকারী, প্রকৃত পরিশ্রমের প্রতিদানকারী।
কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন, ‘রাহমান’ দুনিয়াতে সাধারণভাবে সকলের জন্য দয়ার অর্থে ব্যবহার হয়েছে। আর ‘রাহিম’ পরকালে বিশেষভাবে সকল নেকবান্দাদের জন্য দয়া বর্ষণকারী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ ‘রাহমান’ শব্দটি সাধারণ অর্থে আর ‘রাহিম’ শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত।
আল্লাহ তা‘আলা অসমি দয়ার অধিকারী। কিন্তু সেই দয়া পেতে হলে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। এক. আল্লাহর ইতা‘আত (আনুগত্য) করতে হবে। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসুলের, যাতে তোমাদের ওপর রহমত (দয়া) করা হয়। (সুরা আলে ইমরান -১৩২)
দুই. তাকওয়া অবল¤^ন করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, আমার আজাব তারই ওপর পরিব্যাপ্ত এবং আমার রহমত (দয়া) সকল বস্তুর ওপর পরিব্যাপ্ত। সুতরাং তা তাদের জন্য লিখে দেব যারা ভয় রাখে। (সুরা আ‘রাফ -১৫৬)
তিন. সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ করতে হবে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই ওপর আল্লাহ তা‘আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, সুকৌশলী।’ (সুরা তাওবাহ-৭১)
আল্লাহ তা‘আলার দয়া সম্পর্কে রাসুলে কারীম সা. ইরশাদ করেন, হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো এক যুদ্ধে আল্লাহর রাসুল সা.-এর নিকট কিছু যুদ্ধবন্দি উপস্থিত হলে সেখানে দেখা গেলো এক নারী তার সন্তানকে খুঁজছে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবন্দীদের মাঝে একটি শিশুকে পেয়ে তাকে নিয়ে জড়িয়ে ধরল এবং দুধ খাওয়ালো। আল্লাহর রাসুল সা. আমাদেরকে বললেন, তোমরা কি মনে কর, এই নারী তার সন্তানকে আগুনে ফেলে দিবে? আমরা বললাম, না আল্লাহর শপথ। (সে ফেলবে না) যতক্ষণ সে তাকে না ফেলে থাকতে পারে। অতঃপর আল্লাহর রাসুল সা. বললেন, এই নারী তার সন্তানের প্রতি যতটা না স্নেহময়ী, দয়ালু- আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি তার চেয়েও বেশি দয়ালু। (বুখারী, হাদিস নং ৫৯৯৯, মুসলিম, হাদিস নং- ২৭৫৪)
অন্য এক হাদিসে রাসুল সা. ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা দয়াকে ভাগ করে তাঁর নিকট নিরানব্বইটি ভাগ সঞ্চিত রেখেছেন এবং পৃথিবীতে একভাগ নাযিল করেছেন। আর এই একটি অংশের মধ্যেই সকল সৃষ্টি পরস্পরকে দয়া করে। এমনকি ঘোড়া তার সন্তান আহত হওয়ার ভয়ে তার থেকে ক্ষুর উঠিয়ে নেয়। (বুখারী-৬০০০, মুসলিম- ২৭৫২)