১৯৯১ সালের ২৩ আগস্ট বাংলার রাজনৈতিক আকাশে একটি সূর্য উদিত হয়। জাহিলিয়াতের নিকষকালো অন্ধকার ভেদ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বকে আলোকিত করার প্রত্যয়ে এ সূর্যের উদয়। বাংলার রাজনৈতিক আকাশে উদিত সে সূর্যটির নাম ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন। বিশ্ব রাজনীতি ও দেশীয় প্রেক্ষাপটের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে এ সংগঠনের জন্ম। গত শতাব্দীর শেষভাগে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বের দিকে দিকে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার আওয়াজ বুলন্দ হতে থাকে। তুরস্কের ওসমানী খেলাফতের পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের নেতৃত্বের আসন থেকে ছিটকে পড়া মুসলমানরা চরম নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। মুসলিম উম্মাহ’র কার্যকর শক্তি ‘তরুণ-যুব সমাজ’ সাম্রাজ্যবাদের বুকে লাথি মেরে নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। সময়টা ছিল বিশ্ব রাজনীতির বাঁক নেয়ার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকটি ছিল দেশের রাজনীতির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ও ঘটনাবহুল। জাতীয় রাজনীতি এক অস্থির সময় অতিক্রম করছিল। স্বাধীনতার দুইদশক অতিবাহিত হলেও স্বাধীনতার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। অন্নহীনের হাহাকার, কর্মহীনের আহাজারি ও সম্ভ্রমহীনের স্বলজ্জ চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারি হচ্ছিল। দুর্নীতি-দুঃশাসন ও শাসকশ্রেণির বিশ্বাসঘাতকতায় জাতি আশাহত হচ্ছিল। একসাগর রক্ত পেরিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার সূর্য কালো মেঘে ঢাকা পড়তে যাচ্ছিল। শকুনীর হিংস্র থাবায় রক্তাক্ত হচ্ছিল আমাদের মানচিত্র। ভিনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের তাহযিব-তমদ্দুন, বোধ-বিশ্বাস বিকৃত হচ্ছিল। ছাত্ররাজনীতি তার মৌলিকত্ব ও স্বকীয়তা হারিয়ে ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। আদর্শ চর্চা বাদ দিয়ে সন্ত্রাস নির্ভর হয়ে পড়েছিল। এমনই এক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ইশা ছাত্র আন্দোলনের জন্ম। আমরা শুধু ছাত্ররাজনীতির সীমিত পরিসরে পরিবর্তন আনতে চাই, তা নয়। আমরা যে শুধু ক্ষমতার পালাবদল চাই, তাও নয়। বরং আমরা এদেশের সমাজব্যবস্থার সকল স্তরে আমূল পরিবর্তন চাই। সকল অন্যায়ের মূল উৎস এ কুফরি সংবিধানের পরিবর্তন চাই। সর্বাত্মক বিপ্লব-সাংবিধানিক পরিবর্তন তো সহজবোধ্য নয়। এর জন্য চাই সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ। সমাজবিপ্লবের জন্য মৌলিকভাবে চাই সমাজ নেতৃত্ব। ছাত্র আন্দোলন যোগ্য নেতৃত্ব তৈরিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
গত ছাব্বিশ বছরে আমরা আমাদের সামর্থের সবটুকু দিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। একটি টেকসই ও সফল ইসলামী বিপ্লবের মজবুত ভিত তৈরির চেষ্টা করেছি। হাজারো সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে আমরা এদেশের ছাত্র রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছি। প্রতিনিয়ত ‘রাজনৈতিক কালবৈশাখী ঝড়’ মোকাবেলা করে সমাজবিপ্লবের কঠিন, দুর্গম ও রক্তপিচ্ছিল দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি। নদীর স্র্রোতধারা যেমন প্রতিকূল হাওয়ায় তরঙ্গায়িত হয়ে এঁকে-বেঁকে আপন পথ তৈরি করে এগিয়ে চলে, ছাত্র আন্দোলনের স্র্রোতধারাও প্রতিকূল হাওয়ায় আন্দোলিত হয়ে আপন পথ তৈরি করে ক্রমাগত এগিয়ে চলছে। ২৬ বছরের দীর্ঘ পথচলায় লক্ষ লক্ষ সদস্য, কর্মী ও দায়িত্বশীল ভাইদের নিঃস্বার্থ কুরবানী আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়। হতাশার ঘোর অন্ধকারে আশার আলো দেখায়। ২৭তম বর্ষে পদার্পণের এ শুভলগ্নে সর্বস্তরের সাবেক দায়িত্বশীল, সদস্য ও শুভাকাঙ্খিদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা পেশ করছি। গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি সেসব শহীদদের কথা, যাঁরা ছাত্র আন্দোলনের ছায়াতলে থেকে বাতিলের বিরুদ্ধে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেছেন। সে সকল ভাইদের কথাও স্মরণ করছি, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বিপ্লবের পথ সব সময়ই কণ্টকাকীর্ণ হয়। এ পথে চলতে গেলে হাজারো বাধা পথ আগলে দাঁড়ায়। এখানে প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। কিন্তু একজন বিপ্লবী পরিস্থিতির প্রতিকূলতায় ঘাবড়ে যায় না। হাল ছেড়ে দেয় না। বরং পরিস্থিতির পরিবর্তনে বারংবার চেষ্টা চালায়। বিপ্লবী সে-তো উৎসর্গিত মানবতার স্বার্থে! সীমাবদ্ধতার শৃঙ্খল তাকে কিভাবে বেঁধে রাখবে? বিপ্লবী সে-তো সকল সংকীর্ণতা, গড়িমসির আচ্ছন্নতাকে দুমড়ে মুচড়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। পিছুটান আর তিক্ততাকে ভুলে ত্যাগের দৃষ্টান্ত দেখায়। ঘোর অন্ধকারেও আশার আলো দেখে ও দেখায়।
হে বন্ধু!
এসো, আজ নতুনভাবে শপথ নেই, পুরাতনকে ভেঙে নতুনকে গড়ার। এসো, সমাজবিপ্লবের ক্লান্তিহীন পথে অবিরাম গতিতে এগিয়ে চলি। এসো, তারুণ্যের শক্তি দিয়ে নতুন যুগের সূচনা করি। বহমান এ প্রবল স্রোত পাল্টে দিয়ে নতুন স্রোতধারা তৈরি করি। কারণ, স্রোতকে ঠেকানোর জন্য পাল্টা স্রোতের প্রয়োজন। এসো, হে কা-ারী! উত্তাল সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঢেউয়ের তরঙ্গমালা ভেঙ্গে দক্ষ নাবিকের ন্যায় সতর্ক প্রহরায় বিপ্লবের এ তরী তীরে ভিড়াই। আমরা পারবো, ইনশাআল্লাহ।