ছাত্র রাজনীতি : সংজ্ঞায়ন ও সমকালীন বিশ্লেষণ
শেখ ফজলুল করীম মারুফ, কেন্দ্রীয় সভাপতি
ছাত্ররাজনীতি’র সংজ্ঞা-
দুইভাবে এটাকে সংজ্ঞায়ন করা যায়।
১. ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা তোলা, এজেন্ডা হিসেবে গ্রহন করানো এবং সেই এজেন্ডার পক্ষে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে কতৃপক্ষকে চাপ প্রয়োগ করার জন্য পরিচালিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ছাত্ররাজনীতি বলা যায়।
২. জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় কোন রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখা হিসেবে ছাত্রদের মাঝে সেই দলের সমর্থন তৈরী করা, নেতৃত্ব তৈরী করা এবং সেই দলের স্বার্থে ছাত্রদেরকে ব্যবহার করাকে ছাত্ররাজনীতি বলা যায়।
বাহ্যিক তত্ত্বগত দিক থেকে বা বুদ্ধিজীবীদের ঔচিৎতের বয়ানে প্রথম সঙ্গা যথার্থ মনে হলেও দ্বিতীয় সঙ্গাটাই বাস্তবে সম্মত। এবং বিশ্বে ছাত্ররাজনীতি বলে যা হয় সেটা এটাই। যদিও বাংলাদেশের ধরনে বিশ্বের অন্য কোথায় ছাত্ররাজনীতি দেখা যায় না। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি দ্বিতীয় সংজ্ঞা মতে হলেও এর মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা আছে।
বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে যাদের মুল লক্ষ্যই হলো রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। সেই রাজনৈতিক দলের অনুসারী ছাত্র সংগঠনের ছাত্ররাজনীতি হলো দলকে ক্ষমতায় নেয়ার জন্য এবং দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করণীয় সেটা করা। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল এই ধারার রাজনীতি করে।
আর কিছু সংগঠন রয়েছে যারা দেশের শাসনক্ষমতায় আদর্শিক পরিবর্তন চায়। সেইসব সংগঠনের ছাত্র সংগঠনগুলোর ছাত্ররাজনীতি হলো, ছাত্রদের মাঝে নিজের আদর্শ প্রচার করা, ছাত্রদেরকে সেই আদর্শের কর্মী বানানো এবং ছাত্রদের মধ্যে থেকে সেই আদর্শের সংগ্রামকে দীর্ঘমেয়াদে পরিচালিত করার জন্য নেতৃত্ব তৈরী করা। ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন ও ইসলামী ছাত্রশিবির এই ধারার ছাত্র রাজনীতি করে।
ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন ইস্যুতে ছাত্র সংগঠনগুলোর ভুমিকা বুঝতে হলে ছাত্ররাজনীতি উপরুক্ত বয়ান বুঝতে হবে। ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন ইস্যুতে ক্ষমতার রাজনীতি করা ছাত্র সংগঠনগুলোর ভুমিকা কি হবে সেটা নির্ভর করে তাদের ক্ষমতা প্রাপ্তি ও হারানোর সম্ভবনার ওপরে। ছাত্র সংশ্লিষ্ট কোন ইস্যুকে কেন্দ্র করে যদি কোন আন্দোলন সংগঠিত করে সরকারের পরিবর্তনের কোন সম্ভবনা দেখা যায় তাহলে বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন সেই আন্দোলনে অংশ নেবে বা নেতৃত্ব দেবে। আন্দোলনে সরকার পতনের সম্ভবনা যত বেশী হবে সেই আন্দোলনে বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনের একাত্বতা ও অংশগ্রহন তত বেশী হবে। আবার যখনি সেই আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের সম্ভবনা কমে যাবে তখনই সেই আন্দোলন বা ইস্যু থেকে বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো আনুপাতিক হারে সরে আসবে।
অপর দিকে সরকারী ছাত্রসংগঠন যদি দেখে যে ছাত্র সংশ্লিষ্ট কোন ইস্যুতে সরকারের কোন ক্ষতি হবে না তাহলে তারা সেখানে থাকে। কিন্তু সরকারের কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা দেখলেই ইস্যু যত যৌক্তিকই হোক সরকারী ছাত্র সংগঠন সেই ইস্যু থেকে সরে আসবেই এবং বিরোধীতা করবেই।
আদর্শ ভিত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলোর ভুমিকা কি হয়?
তারা যেকোনো ছাত্র সংশ্লিষ্ট ইস্যুকে লুফে নেয় এই জন্য যে, এর মাধ্যমে তারা ছাত্রদের কাছে নিজেদের আদর্শ প্রচার করতে পারবে এবং নিজ আদর্শের পক্ষে ছাত্রদেরকে টানতে পারবে। তারা কোন ইস্যুতে ততক্ষণই মাঠে থাকে যতক্ষণ সেটা চুড়ান্ত ঝুঁকিপুর্ন না হয়ে ওঠে। যখন কোনো ইস্যু এতোটাই ঝুঁকিপুর্ন হয়ে ওঠে যে, রাষ্ট্র এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে দমন করতে বদ্ধপরিকর তখন আদর্শিক সংগঠনগুলোও তাদের দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্যের স্বার্থে সেই ইস্যু থেকে সরে আসে।
এখন যে প্রশ্নটা খুব জোড়ালোভাবে সামনে আসবে সেটা হলো, তাহল ছাত্রস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুর কি হবে?
এই প্রশ্নের জবাব পেতে আগে কয়েকটা জিনিস বুঝতে হবে। কোন রাষ্ট্র যখন ছাত্রদের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তখন সেটা কি সেই রাষ্ট্রের একমাত্র সমস্যা? যার সমাধান করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে? নাকি সেটা সেই রাষ্ট্রের চরিত্রগত সমস্যার একটা বহিঃপ্রকাশ মাত্র? আরো স্পষ্ট করেই বলি। সরকার কোটা নিয়ে যে বৈষম্যের পক্ষ নিয়েছে এবং ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে সেটা কি এই সরকার কেবল এই ক্ষেত্রেই নিয়েছে? নাকি এটা সরকারের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য? যার একটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই কোটা ইস্যুতে? সবাই একমত হবেন যে, বৈষম্যের পক্ষ নেয়া এবং ছলচাতুরী করা কেবল এই কোটা ইস্যুতেই ঘটেছে এমন না বরং এটা তাদের চরিত্রগত সমস্যা। কোটা ইস্যুতে তার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মাত্র।
এখন এর সমাধান কি?
কেবল এই ইস্যুতে তাদের এই চরিত্র সংশোধন করলেই রাষ্ট্রের সকল স্থান থেকে তাদের এই বৈষম্যনীতি ও ছলচাতুরী বন্ধ হয়ে যাবে? নিশ্চই না। এই ক্ষেত্রে বন্ধ করা গেলেও অন্যত্র তারা এটা করেই যাবে। সেজন্য এই ইস্যুতে কোন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন সর্বস্ব বাজী ধরতে পারে না। এবং কেউই সেটা ধরে নাই। হ্যা! এই ইস্যুতে তাদেরকে বাধ্য করা গেলে বৈষম্যনীতি ও ছলচাতুরী চরিত্র বন্ধের একটা ধারা তৈরী হতো বটে। কিন্তু তার জন্য যে চড়া মুল্য দিতে হতো সেটা আয়নার চেয়ে বায়না বেশী হয়ে যেতো।
ক্ষমতার রাজনীতি করা ছাত্র সংগঠনগুলো এই আন্দোলনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলো। কারন এই ইস্যুতে তারা ক্ষমতার পটপরিবর্তনের দুরতম হলেও আশা দেখতে পেয়েছিলো। কিন্তু আদর্শিক সংগঠনগুলো এই আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান বাস্তবতায় আদর্শিক পরিবর্তনের দুরতম কোন সম্ভবনাও দেখে নি। তাই তারা এখানে ততটুকুই অংশ নিয়েছে ততটা নিলে তাদের মুল লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে।
ছাত্র সংগঠনগুলোর এই অবস্থান নেয়ার মুল কারন হলো, যেহেতু এই আন্দোলনের মাধ্যমে বৈষম্যনীতি ও ছলচাতুরীপুর্ন রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না সেহেতু এখানে সর্বস্ব বাজী না ধরে বরং স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রকে সাম্য ও মানবিক করার জন্য শক্তি জমা রাখা উচিৎ। এখন ক্ষমতার রাজনীতি করা সংগঠনগুলো মনে করে তারা ক্ষমতায় গেলে এর প্রতিকার হবে তাই এখানেই সব শক্তি ক্ষয় না করে তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য শক্তি জমা রেখেছে এবং আরো শক্তি অর্জনের পথে হেটেছে।
আদর্শিক সংগঠনগুলো মনে করে যে, কেবল ক্ষমতার পালাবদলই নয় বরং সামগ্রিক নীতিগত পরিবর্তন ছাড়া এর সমাধান সম্ভব না আর সামগ্রিক পরিবর্তন এই আন্দোলনের মাধ্যমে সম্ভবও না সেজন্য তারা এখানে সব শক্তি ব্যায় না করে সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্য শক্তি জমা রেখেছে।
ছাত্রদের সমস্যাকে সমাজের অন্যসব সমস্যা থেকে আলাদা করে দেখার এবং সেটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার অবকাশ কতখানি?
সমাজের অন্যসব মৌলিক সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে কেবল ছাত্রদের সমস্যাকে গুরুত্ব দেয়া মুল সমস্যাকেই আড়াল করে দেয়। মানুষের মৌলিক যে পাঁচটা অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা কোনটাই নাগরিকরা ঠিকভাবে পাচ্ছে না। নিরাপত্তা ইস্যু বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে ভয়ংকর ইস্যু। মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে, রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সীমান্তের ওপার থেকে। সমাজের প্রতিটা স্তরে পক্ষে-বিপক্ষে তৈরী করে বৈষম্য হচ্ছে। এর মাঝে ছাত্রদের সমস্যা একটা সমস্যা।
ছাত্রদের এই সমস্যা বর্তমান সময়ের প্রধান সমস্যা নয় বরং প্রধান সমস্যার একটা বহিঃপ্রকাশ। এইডস হলো মুল সমস্যা। আর বগলের তলায় ফোঁড়া হওয়া তার একটা বহিঃপ্রকাশ। এখন মুল এইডসের চিকিৎসা দরকার। বগলের ফোঁড়ার পেছনে সব টাকা ব্যয় করা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।
সেজন্য কার্ল মার্ক্স পর্যন্ত নারীবাদ নিয়ে আলাদা কোন কথা বলেন নাই। তিনিও নারী সমস্যাকে সমাজের মুল সমস্যার অন্তর্গত সমস্যা আকারে দেখেছেন এবং সমাজের সমস্যা সমাধানের ওপরে জোড় দিয়েছেন। তেমনি ছাত্রদের সমস্যাও মুল সমস্যার অন্তর্গত একটা সমস্যা।
বিভিন্ন সমস্যাকে আলাদা করে দেখানো এবং তার সমাধানে ভিন্ন ভিন্ন বয়ান তৈরী করা একটা পশ্চিমা ফাজলামী। সমাজের সমস্যাগুলোকে আলাদা আলাদা দেখিয়ে এবং সেগুলো নিয়ে নানা আলোচনা করে মুল সমস্যা থেকে নজর সরিয়ে দেয়া হয়।
আদর্শিক সংগঠনগুলো পশ্চিমা এই ফাঁদে পা না দিয়ে সমাজে বৈষম্য ও ছলচাতুরীর মুল সমস্যাকে চিহ্নিত করে সেটা সমাধানের জন্য কাজ করে। তাতে পশ্চিমা চিন্তার গোলাম বুদ্ধিজীবী ও উঠতি ফেসবুক বুদ্ধিজীবীদের কাছে মনে হতে পারে যে, আদর্শিক সংগঠনগুলো কোটা সমস্যাকে পাশকাটিয়ে গেলো। কিন্তু এটা পাশকাটানো না বরং সমস্যাকে তার মুল থেকে সমাধান করার পথেই তারা হাটছেন।
যারা তাদের কোঠরি-স্বার্থে নিমজ্জিত এবং সংকীর্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে আদর্শিক রাজনৈতিক সংগঠনকে মুল্যায়ন করেন তারা মনে করেন যে, তাদের স্বার্থেই দলগুলো সর্বস্ব দিয়ে আন্দোলন করা উচিৎ। সেটা না করলেই তারা “আশ্চর্য এরাও ছাত্ররাজনীতি করে?” বলে আক্ষেপ করেন।
বিনয়ের সাথেই বলি, বছরে ছয়লাখের মতো সরকারী চাকুরীতে ৫৬% কোটা থাকলে যে পরিমান মানুষের সাথে বৈষম্য করা হয় তারচেয়ে হাজারগুন বেশী বৈষম্য ও নির্মমতা করা হচ্ছে দেশের কোটি কোটি মানুষের সাথে। জাতীয় আয়ের ৩৮% খাচ্ছে ধনিক ১০% মানুষ। আর সর্বনিম্ন গরীর ১০% মানুষ পাচ্ছে জাতীয় আয়ের মাত্র ১%।
এই বিভৎস বৈষম্যের বিরুদ্ধে তো কোনো ফেসবুক বুদ্ধিজীবীকে রাজপথে আন্দোলন করতে দেখা যায় নি। কোটার কারনে সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে বছরে তিনলাখ (কমবেশী) মানুষের সাথে কৃত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সেই দুইহাজার আটের পরে একবার আন্দোলন করেই যে ফেসবুক বুদ্ধিজীবীরা বছরের পর বছর মাঠের রাজনীতি করা সংগঠনগুলোকে রাজনীতির সবক দেয় তারা আসলে নিজ স্বার্থে অন্ধ।
তারা সমাজের মৌলিক সমস্যাকে উপেক্ষা করে তাদের সংকীর্ন স্বার্থে সর্বস্ব ব্যয় করার জন্য রাজনৈতিক সংগঠনের কাছে আশা করে। না পেলে বুদ্ধুিজীবির উন্নাসিকতা দেখায়।
এদের ক্ষেত্রে আবারো আহমদ সফাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। “বুদ্ধিজীবিরা যা বলেছিলেন তা শুনলে দেশ স্বাধীন হতো না এবং তারা এখন যা বলছেন তা শুনলেও দেশকে এগিয়ে নেয়া যাবে না।”